পশুরা এমনকি স্তন্যপায়ীরাও এই মিথ তৈরি করতে পারে না বলে তাদের সমাজে কোন দ্রুত কোন পরিবর্তন আসে না। শিম্পাঞ্জীরা যেমন একজন আলফা মেইলের নেত্ত্বে জীবনযাপন করে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তারা তাই করে আসছে। মানুষ কিন্তু এমন না। কেবল গল্প বলেই তারা সমাজের খোলনলচে পালটে দিতে পারে। রুশো ভলতেয়াররা জাস্ট গল্প বলেই ফ্রেঞ্চ বিপ্লবের মঞ্চ প্রস্তুত করে দিয়েছিলেন। যুগের পর যুগ ধরে ফ্রেঞ্চ জনগণ বিশ্বাস করতো—সম্রাটই সকল ক্ষমতার উৎস। রুশো, ভলতেয়ারের গল্প পড়ে তাদের মনে হল, রাজা নয়, তারা, সামান্য মানুষেরাই আসলে সকল ক্ষমতার উৎস। ফলাফল? মাস তিনেকের ব্যবধানে তারা রাজতন্ত্রকে ছুঁড়ে ফেলে দিল ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে।
মানুষের এই এক অদ্ভূত ক্ষমতা। মানুশ স্রেফ গল্প বলেই হাজার বছরের প্রথা ও সংস্কার ভেঙে দিতে পারে। শিম্পাঞ্জীদের সমাজে কখনো দেখবেন না আলফা মেইলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে কেউ গণতান্ত্রিক সমাজের প্রবর্তন করেছে। ওদের যে গল্প বলার কেউ নেই।
এই ব্যাপারটাই নিয়েন্ডারথালদের বিরুদ্ধেও আমাদের এগিয়ে দেয়। নিয়েন্ডারথালরা যেখানে একা একা কিংবা ছোট ছোট গ্রুপে শিকার করতে যেতো, আমরা যেতাম বড়সড় দল বেঁধে। তারপর টার্গেটকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরতাম। একা একটা নিয়েন্ডারথালের সাথে আমাদের পারার কথা না। সেই আমরাই যখন দল বেঁধে এগোতাম, কোন শক্তিই আমাদের দাবায়ে রাখতে পারতো না।
নিয়েন্ডারথালরা হয়তো একে অন্যকে বলতে পারতো—শত্রুর অবস্থান কোথায়। কিন্তু আমরা জানতাম গল্প বুনতে। সেই গল্প আমাদের ধমনীতে প্রবাহিত হয়ে আমাদের এক ‘ইউনিটি’র স্বাদ দিত। যুদ্ধের ময়দানে চিরকালই অস্ত্রের চেয়ে এই ইউনিটি-টাই বেশি কাজ দিয়েছে। তা সে ভিয়েতনাম যুদ্ধই হোক কিংবা নিয়ান্ডারথালদের বিরুধে হোমো সেপিয়েন্সদের লড়াই।
মানবজাতির এই দীর্ঘ ইতিহাসে আমাদের ডিএনএ’র তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি, অথচ আমাদের ভেতরে বহু ওলট-পালট হয়ে গেছে। মানুষ এই ওলট-পালটে দিশেহারা হয়ে পড়ে না। কেননা, সে নিজেকে বদলে নিতে জানে। আরেকজনের বোনা মিথের সাথে সে অতি দ্রুত নিজেকে রিলেট করতে জানে।
ক্যাথলিক যাজকদের কথাই ধরুন না। এরা ধর্মের সেবায় চিরকুমার থাকার ব্রত নেন। অথচ মানুষের শরীরে ‘কুমার’ থাকার কোন জিন নেই। বরং শরীর জুড়ে কুমার না থাকার জিন আর হরমোনের ছড়াছড়ি। টেস্টোস্টেরন, ডোপামিন, সেরোটোনিন। ক্যাথলিক যাজকরা তবে কীভাবে এইসব জিন আর হরমোনের ফাঁদ এড়িয়ে চলেন? এর উত্তরও আমাদের খুঁজতে হবে ক্রিশ্চান মিথের মধ্যে। মিথের শক্তি অনেক সময় আমাদের জিন আর হরমোনের চেয়েও অনেক বেশি।
গল্প বলার আর মিথ তৈরি করার এই অদ্ভূত ক্ষমতা আছে বলেই মানুষ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। এমন একটা লোকের কথা ভাবুন যার ১৯১৫ সালে জন্ম আর ২০১৫ সালে ম্ত্যু। এই লোক ব্রিটিশ আমলে পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন করেছে, আবার পাকিস্তান আমলে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য আন্দোলন করেছে। সে হয়তো নব্বইয়ের গণআন্দোলনেও অংশ নিয়েছে। প্রতিবারই তার চারপাশে নতুন নতুন মিথ তৈরি হয়েছে। সেই মিথে সে বিশ্বাস করেছে বলেই একটা বড় ইমাজিনড রিয়েলিটির অংশ হতে পেরেছে সে। প্রতিবারই সে মিছিলে গিয়েছে। আরো হাজারটা মানুষকে মিছিলে দেখেছে। মিছিলের অংশ হতে পারাটাও কিন্তু এক ধরনের এ্যাচিভমেন্ট।
কাজেই, হোমার আর হুমায়ূন আহমেদরাই যে কেবল গল্প বলেন —তা না। প্রতিটা সফল মানুষই আমাদের গল্প বলে চলেছেন। মুহম্মদ আমাদের বলেন, এক ভাই অন্য ভাইয়ের উপকার করতে। তবেই পরকালে মুক্তি মিলবে। বঙ্গবন্ধু আমাদের একটা সুখী, সম্দ্ধ বাংলাদেশের গল্প বলেন। সেই গল্পই একদিন আমাদের স্বাধীনতা এনে দেয়। স্টিভ জবস আমাদের বলেন—আইফোন ব্যবহার করতে। তবেই জগতের যাবতীয় সুখ মিলবে। আমরা তার গল্পে মুগ্ধ হয়ে এ্যাপল স্টোরের সামনে রাতভর লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকি।
দিনশেষে ধর্ম বলেন, রাজনীতি কিংবা ব্যবসা—সকল ক্ষেত্রেই সফল মানুষেরা একজন বড় গল্পকার। আমাদের বেঁচে থাকার অক্সিজেন বর্ণহীন, গন্ধহীন, স্বাদহীন কোন গ্যাস নয়, আমাদের বেঁচে থাকার অক্সিজেন এই গল্পগুলোই।
০২. আপনার হাজব্যান্ড বা ওয়াইফ
আপনার হাজব্যান্ড বা ওয়াইফ কি বিয়ের এতো বছর পরেও অন্য নারী/পুরুষ দেখলেই ছোঁক ছোঁক করেন?
আপনারা বাবার কি ডায়বেটিক? হাজারবার মানা করা সত্ত্বেও উনি কি মিষ্টি জাতীয় খাবারের লোভ সামলাতে পারেন না?
কিন্তু কেনো এই ঘটনাগুলো ঘটছে? কে দায়ী এইসবের পেছনে?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আসলে আমাদের আশেপাশে তাকিয়ে পাওয়া যাবে না। এর উত্তর পেতে হলে আমাদের একটু পেছনে ফিরতে হবে। বেশি পেছনে না। মাত্র ৩০ হাজার বছর আগে। যখন আমরা শিকার আর ফলমূল সংগ্রহ করে বেঁচে ছিলাম। আমাদের সেই আদিপুরুষদের মনস্তত্ত্ব ঘাঁটলেই আমাদের আজকের মনস্তত্ত্বের কিছুটা আঁচ পাওয়া যাবে।
প্রথমেই আপনার বাবার সমস্যাটা সল্ভ করি। কথা হল, মিষ্টি জাতীয় খাবারের প্রতি আপনার বাবার এতো আকর্ষণ কেনো? এই আকর্ষণ কি তার বাবা, তার বাবা এবং তার বাবারও ছিল?
উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ, ছিল। আমাদের পূর্বপুরুষেরা যখন বনেজঙ্গলে ঘুরে বেড়াতো, তাদের খাবারের স্টক ছিল সীমিত। হাই ক্যালরি ফুড তো ছিল না বললেই চলে। অথচ শিকারের জন্য তো হাই ক্যালরি ফুডের দরকার। আর এই হাই ক্যালরি ফুডের একমাত্র উৎস ছিল পাকা ফলমূল। বনেজঙ্গলে তাও ছিল দুষ্কর। আমাদের গ্রেট গ্রেট দাদী-নানীরা তাই যখনই কোন পাকা ফলের সন্ধান পেতেন, অমনি ধরে তা গাপুস গুপুস খেয়ে ফেলতেন। যেন স্থানীয় বদমাইশ বেবুনের দল এর সন্ধান পাবার আগেই তারা সব ক্যালরি শরীরস্থ করে ফেলতে পারেন। বেবুনের দল মারা খাক।