আচ্ছা, আমরা যদি নিয়েন্ডারথাল ডিজাইন করতে পারি, স্যাপিয়েন্স-ই বা কেন ডিজাইন করতে পারবো না? আর স্যাপিয়েন্স ডিজাইন তো খুব কঠিন কিছু না। যেখানে আমরা ইঁদুর ডিজাইন করে তার বুদ্ধিশুদ্ধি বাড়িয়ে দিচ্ছি, সেখানে মানুষ কেন পারবো না? ইঁদুরের শরীরে DNA বেস আছে প্রায় আড়াই বিলিয়নের মত। মানুষের শরীরে সেটা ২.৯ বিলিয়ন। মাত্র ১৪% বেশি। ইঁদুরে যদি হয়, মানুষে কেন নয়? জিনিয়াস ইঁদুর যদি হয়, জিনিয়াস মানুষ কেন নয়? চরিত্রবান ইঁদুর যদি হয়, চরিত্রবান মানুষ কেন নয়?
সত্যিটা হচ্ছে এই যে, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং আমাদের শরীরে একটা বড় ধাক্কা দিতে যাচ্ছে। হয়তো আর কয়েক দশকের মধ্যেই। আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে, গড় আয়ু বাড়বে, হয়তো অমরত্বও পেয়ে যেতে পারি আমরা। শরীরের ধাক্কা তো আমরা নিতে পারবো। কিন্তু আমাদের মনের ভেতর এটা যে ধাক্কা দিবে, আমাদের সোশ্যাল স্ট্রাকচারে যে ধাক্কা দিবে—সেই ধাক্কা আমরা নিতে পারবো তো?
তার চেয়েও বড় প্রশ্ন—আমরা Homo sapiens ই থাকবো তো? নাকি বাপ-দাদাদের মুখে চুনকালি মেখে আমরা এমন কিছুতে পরিণত হবো যাকে কোনভাবেই আর Sapiens বলা যাবে না?
খালি চোখে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনকে খুব শাদামাটা একটা গল্প মনে হয়। এক বিজ্ঞানী যিনি কিনা একটা আর্টিফিশিয়াল সত্তা তৈরি করেন, যেটা পরে কন্ট্রোলের বাইরে চলে যায়। বাজারে এরকম ভুরি ভুরি সায়েন্স ফিকশন আছে। এইসব গল্পের মূল বক্তব্যই হচ্ছে—আমরা যদি বেশি তেড়িবেড়ি করি, নিজেদের ঈশ্বরের সমকক্ষ ভাবা শুরু করি—তাইলে আমাদের খবরই আছে।
এর বাইরেও কিন্তু এই গল্পের একটা গভীর তাৎপর্য আছে।
ফ্রাংকেনস্টাইন আমাদের এই বলে সতর্ক করে দেয় যে, মানবজাতির শেষ ঘনায়া আসতেসে। এই শেষ পারমাণবিক বোমা বা উল্কাপাতের কারণে হবে না। মানুষ নিজেই তার কেয়ামত ডেকে আনতেসে। এই কেয়ামত মানে পৃথিবীর শেষ হয়ে যাওয়া না। এই কেয়ামত মানে প্রজাতি হিসেবে হোমো স্যাপিয়েন্স এর শেষ হয়ে যাওয়া। আমাদের জায়গায় তখন এমন এক প্রজাতির আবির্ভাব হবে, যাদের শরীর তো আমাদের থেকে আলাদা হবেই, এদের আবেগ-অনুভূতিও আমাদের স্কেলে মাপা যাবে না।
এই ভাবনাটাকে আমরা ঠিক নিতে পারি না। আমরা চিরকালই নিজেদের ‘বেস্ট’ জেনে আসছি। আমরা বড় বড় স্কাইস্ক্র্যাপারা বানাবো, মহাকাশ যাবো, মঙ্গলে প্লট বুকিং দিব। সব আমরাই করবো। আমাদের চেয়েও বেটার কেউ থাকতে পারে, এটা আমরা নিতেই পারি না।
কিন্তু সময় তো আর বসে থাকে না। সময় তার নিজের গতিতে এগোয়। যে জন্যে আজ আমরা যে প্রেডিক্ট করি, দেখা যায় ভবিষ্যতে তার কিছুই মেলে না। এ্যাপোলো ১১ যখন চাঁদে গেলো, আমরা স্বপ্নের জাল বুনতে শুরু করলাম। যে ২০০০ সালের মধ্যে আমরা মঙ্গলে থাকা শুরু করবো। সেটা কি হইসে? থাকা তো দূরের কথা, যাইতেই পারলাম না এখন পর্যন্ত। উলটা কী হইলো? আমরা ইন্টারনেট পাইলাম। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাটে নিজেদের প্রাইভেসি নিলামে তুললাম।
কাজেই, ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের আশংকাকে আমরা চাইলেও হেসে উড়ায়ে দিতে পারি না। এ্যাডভান্সড মানুষের কিছু কিছু লক্ষণও তো ইদানীং দেখা দিচ্ছে। আর এই লক্ষণগুলো দেখা দিচ্ছে আমাদের ল্যাবগুলোতে।
ব্রেইন কম্পিউটার ইন্টারফেস যেমন আজকাল বেশ জনপ্রিয় রিসার্চ টপিক। এখানে করা হয় কি, আমাদের মাথার খুলিতে কতগুলো ইলেক্ট্রোড বসানো হয়। ফলে, মস্তিষ্কের ভেতরে যে ইলেকট্রিক্যাল সিগনালগুলো তৈরি হচ্ছে, কম্পিউটারে সেগুলা দেখা যায়। এইটুকু পর্যন্ত ঠিক আছে। এই সিগনাল এ্যানালিসিস করে আপনি রোগ নির্ণয় করবেন। মস্তিষ্কের কোন অংশ কী কাজ করে—এগুলো করবেন। সবই বুঝলাম।
কিন্তু এই সিগনাল্গুলো যদি ইন্টারনেটে ফাঁস করে দেয়া হয়? কিংবা কতগুলা মানুষের এইভাবে পাওয়া সিগনাল্গুলো যদি একসাথে প্যাকেজ আকারে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়া হয়, তখন কী হবে? কিংবা একজন সিগনাল যদি আরেকজনের মস্তিষ্কে ইনপুট হিসেবে দেয়া হয়? একজন মানুষ কি তখন আরেকজনের মস্তিষ্কের ভেতর ঢুকে যাবে? তার ছোটবেলার স্মৃতি, প্রথম প্রেমিকার স্মৃতি, প্রথম পরাজয়—সব জেনে যাবে? মানুষের যে প্রাইভেসি বলে একটা জিনিস আছে—সেই প্রাইভেসির তখন কী হবে? ইনডিভিজুয়ালিজম বলে কি কিছু থাকবে তখন?
এইরকম একটা কালেক্টিভ সত্তাকে কি আমরা আর ‘মানুষ’ বলতে পারি? না, পারি না। এটা হবে সম্পূর্ন নতুন কিছু। এদেরও আবেগ-অনুভূতি, সাইকোলজি সবই থাকবে। আমাদের স্ট্যান্ডার্ড দিয়ে যাকে হয়তো আমরা ব্যাখ্যা করতে পারবো না।
আরেকটা সম্ভাবনা এরকম। ধরেন, আপনি আপনার ব্রেইনের একটা ব্যাক আপ পোর্টেবল হার্ডডিস্কে রেখে দিলেন। তারপর ল্যাপটপে সেটা চালাইলেন। এখন ল্যাপটপ কি আপনার মতই চিন্তা করা শুরু করবে? নাকি বিবর্তনের নিয়ম অনুযায়ী, সেও আগের কিছু ইনপুট আর নিজের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে চিন্তা করা শুরু করবে? যদি সেটাই হয়, তাইলে সেই ল্যাপটপকে আমরা কী বলবো? ল্যাপটপ না মানুষ?
২০০৫ সালে হিউম্যান ব্রেইন প্রজেক্ট নামে এরকমই একটা বিলিয়ন ডোলারের প্রজেক্ট চালু হইসে। এর আল্টিমেট উদ্দেশ্য—কম্পিউটারের মধ্যে মানুষের মস্তিষ্ক পুরাপুরি রিক্রিয়েট করা। এটা যদি হয়, তাহলে ৪ বিলিয়ন বছরের কারাবাসের পর মস্তিষ্ক জৈব যৌগের জাল থেকে মুক্ত হবে। অজৈব যৌগের যে একটা বিশাল জগৎ আছে, ঐখানে তার প্রথম পদচারণা ঘটবে। এর এচূড়ান্ত পরিণতি কী—আমরা জানি না। আদৌ কম্পিউটার আমাদের মস্তিষ্কের জালকে ভেদ করতে পারবে কিনা—তাও আমরা নিশ্চিত নই। কিন্তু চেষ্টা করে দেখতে তো দোষ নাই।