আমরা কিন্তু তারপরও আমাদের জীবনকে একটা মিনিং দেয়ার চেষ্টা করি। বিজ্ঞানী তার জীবনকে এই বলে মিনিং দেন যে, তার গবেষণা মানুষের জ্ঞান ভাণ্ডারকে একটু হলেও সমৃদ্ধ করছে। দেশপ্রেমিক সৈন্য ভাবে যে, তার আত্নত্যাগকে দেশবাসী শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। একজন উদ্যোক্তা আরো দশটা মানুষকে চাকরি দিয়ে, তাদের পরিবারের চলার ব্যবস্থা করে নিজের জীবনকে মিনিং দেন।
এই যে নিজের জীবনকে তাৎপর্য দেবার একটা প্রবণতা—এর মধ্যে একটা বিরাট ফাঁকি আছে। এগুলো আর কিছুই না। নিজেকে বুঝ দেয়া। যে লোকটা দেশের জন্য জান দেয়, সেই দেশটাই তো পৃথিবীর মানচিত্র থেকে এক সময় হারিয়ে যেতে পারে। তখন কে তাকে স্মরণ করবে? যে মানুষী কষ্ট করে সন্তান মানুষ করে, সেই সন্তান যে তাকে ছেড়ে চলে যাবে না—তার গ্যারান্টি কী?
এরপরও মানুষ তার জীবনের একটা অর্থ খুঁজে বেড়ায়। যতক্ষণ একটা লক্ষ বা উদ্দেশ্য থাকে জীবনে, সুখের আয়ুও ঠিক ততোক্ষণই।
বায়োইঞ্জিনিয়ারিং এর শুরু বিশ বা একুশ শতকে না।
১০ হাজার বছর আগে মানুষ যেদিন ষাঁড়কে খোঁজা করে বলদ বানিয়েছিল, সেদিন থেকেই বায়োইঞ্জিনিয়ারিং এর শুরু। বলদ নামটার মধ্যেই এর সাবমিসিভ আচরণ নিহিত। এরে পোষ মানানো সোজা। এরে দিয়ে লাঙল টানানোও সোজা।
গবাদি পশু খোঁজা করেই মানুষ ক্ষান্ত দেয় নাই। নিজের ছেলেরেও সে খোঁজা করে দিসে। সেই ছেলেকে নাচেগানে পারদর্শী করে তুলসে। সুলতানের হারেমে বেগম সাহেবাদের সেবাযত্নে কাজে লাগাইসে।
সেকালের বায়োইঞ্জিনিয়ারিং এর সাথে আজকের বায়োইঞ্জিনিয়ারিং এর পার্থক্যটা তাইলে কই? পার্থক্যটা লেভেলে। সেকালের ইঞ্জিনিয়ারিং ছিল খুবই স্থূল লেভেলের। চোখে দেখা যেত। আজকের ইঞ্জিনিয়ারিং সেলুলার লেভেলে, জিন লেভেলে। চোখে দেখা যায় না এমন। আজকে তাই লিঙ্গ বদলানোর জন্য কাউকে খোঁজা করা লাগে না। কিছু হরমোন চেঞ্জ করে দিলেই হল।
এক ব্রাজিলিয়ান ভদ্রলোকের একবার এক শখ হল। উনি এমন একটা খরগোশ পুষবেন যার গা থেকে সবুজ আলোকছটা বেরোবে। উনি এক ফ্রেঞ্চ ল্যাবরেটরীতে খোঁজখবর করলেন। এর জন্য মালকড়ি ছাড়তেও উনার সমস্যা নাই।
ফ্রেঞ্চ বিজ্ঞানীরা একটা খরোগোশের ভ্রূণ নিল। সেই ভ্রূণের ডিএনএ-তে জেলীফিস থেকে পাওয়া সবুজ ফ্লুরোসেন্ট আলোর জিন ঢুকিয়ে দিল। ইয়ো। সেই কাংক্ষিত খরগোশের জন্ম হল যার গা থেকে কিনা সবুজ আভা বেরোয়। ভদ্রলোক এই খরগোশ বাবুর নাম দিলেন Alba.
Alba কোন বিবর্তনের ফসল নয়। নিখাদ ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের ফসল। এখন পর্যন্ত আমরা জী এসেছি, সমস্ত প্রাণীসত্তাই লক্ষ লক্ষ বছর বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের এই পর্যায়ে এসেছে। এই প্রক্রিয়ায় আমরা যে বাম হাত ঢুকাই নি—তা নয়।
আমরা যখন দুবলা পাতলা ভেড়াগুলোকে মেরে মোটা, নাদুশ নুদুশ ভেড়াগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছি—তখনই আমরা এদের ন্যাচারাল বিবর্তনে এক দফা ইন্টারফিয়ার করে ফেলেছি। কবি বলেছেন, ভেড়াকে ভেড়ার মত থাকতে দাও। আমরা তা দিই নি। আমরা ওদের নিজেদের প্রয়োজনমত গুছিয়ে নিয়েছি।
তবু সেটা ছিল বিবর্তনে হস্তক্ষেপ। যাতে কিনা বছরের পর বছর লেগে যেত। আজ আমরা ন্যাচারাল বিবর্তনকে অস্বীকার করে নিজেদের খেয়াল খুশিমত প্রাণীদের ডিজাইন করে চলেছি। এই ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন ব্যাপারটা আমরা কেউ কেউ ঈশ্বরের এখতিয়ারে ছেড়ে চেয়ে বসে ছিলাম। সমস্যা হল, এই সেক্টরে ঈশ্বরের মনোপলি আর নাই। মানুষও এই বিজনেসে নামসে।
এখনো পর্যন্ত আমরা ছোট ছোট সেক্টরে আমাদের কেরদানি দেখাচ্ছি। E Coli’র মত ব্যাকটেরিয়া দিয়ে আমরা ইনসুলিন তৈরি করছি। তাতে মেলা খরচ বেঁচে যাচ্ছে। উত্তর মেরুর বাসিন্দা মাছের জিন আলুর ভেতর ঢুকিয়ে আলুকে আরো ঠাণ্ডা প্রতিরোধী করে তুলেছি। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটা ঘটেছে ল্যাব র্যাটদের সাথে। জেনেটিক প্রকৌশলীরা আজকাল এমন সব ইঁদুরের জন্ম দিচ্ছেন যাদের র্যাম আর হার্ডডিস্ক, বুদ্ধি আর স্মৃতিশক্তি—দুটোই তাদের পূর্বপুরুষদের চেয়ে অনেক অনেক বেশি।
Vole এর কথা বলি। এরা অনেকটা ইঁদুর টাইপের প্রাণী। অধিকাংশ প্রজাতিই বেশ চরিত্রহীন। মানে আজ একে ধরে তো কাল ওকে ধরে। বিজ্ঞানীরা তো এইসব নষ্টামি পছন্দ করেন না। তারা এমন এক প্রজাতি ডেভেলপ করলেন, যেখানে ছেলে vole আর মেয়ে vole—দুজনেই দীর্ঘস্থায়ী মনোগ্যামাস রিলেশনে বিশ্বাসী। বিজ্ঞানীরা বলছেন, তারা মনোগ্যামীর জিন বের করে ফেলেছেন।
vole এর ক্ষেত্রে যদি এটা করা যায়, মানুষের ক্ষেত্রে নয় কেন? এরশাদ কাকুর শরীরে আপনি মনোগ্যামীর জিন ঢুকিয়ে দিলেন। কাকু আরো দশজনের মত স্ত্রীভক্ত, বিশ্বস্ত, অনুগত স্বামী হয়ে গেলেন। খুব কি খারাপ হয় ব্যাপারটা?
ঘটনা এখানেই শেষ না। বিজ্ঞানীরা ভাবলেন, বাঁচা মানুষ নিয়ে কাজ তো অনেক হল। এবার মরা মানুষ নিয়ে কিছু করা যাক। হার্ভার্ডের এক প্রফেসর প্রস্তাব দিলেন, নিয়েন্ডারথালের জিন মানুষের ভ্রূণে ঢুকায়ে দেখলে কেমন হয়? বেশ ক’জন মহিলা সেই নিয়েন্ডারথাল বাচ্চা পেটে ধরার জন্য কিনা রাজিও হয়ে গেল:P
কথা হল, নিয়েন্ডারথালদের দিয়ে আমরা কী করবো? এরা ধ্বংস হইসে তো হইসে, এদের আবার বাঁচায়ে তোলার কী দরকার?
দরকার আছে। নিয়েন্ডারথাল মস্তিষ্কের সাথে আমরা যখন আমাদের স্যাপিয়েন্স মস্তিষ্কের তুলনা করবো, তখনই আমরা বুঝতে পারবো—দুই ভাইর মধ্যে পার্থক্যটা আসলে কী। ঠিক কী কারণে আমরা যাকে Consciousness বলি, বাংলায় চেতনা বলি—এই চেতনা আমাদের মধ্যে ডেভেলপ করসে। লোকে হয়তো টাকা দিয়ে নিয়েন্ডারথাল কিনেও নিবে। দু’জন কাজের মানুষ যে খাটনিটা খাটতে পারতো, একা একটা নিয়েন্ডারথাল সেটা খেটে দিবে।