আবার শুরুতে ফিরে আসি। সুখ যে আপেক্ষিক—এটা তো কবি, সাহিত্যিক আর ফিলোসফাররা আমাদের অনেক আগেই বলে গেছেন। বিজ্ঞানীদের তাহলে কী দরকার মিলিয়ন ডলার খরচ করে গবেষণা করে একই জিনিস বের করার?
দরকার আছে। আমাদের গন্তব্য এক। গন্তব্যে পৌঁছানোর পথ অনেক। বিজ্ঞানীরা সেই অনেকগুলো পথের একটা পথের যাত্রী মাত্র।
কেমিক্যাল হ্যাপিনেস এর আইডিয়াটা একদম নতুন কিছু না।
১৯৩২ সালে Brave New World নামের একটি উপন্যাসে এই আইডিয়াটা একটা কংক্রীট ফর্মে প্রথমবারের মত হাজির হয়। লেখক এইখানে দেখান, জাগতিক সাফল্য, প্রতিষ্ঠান—এগুলো আমাদের সুখ এনে দিতে পারে না। সুখ আসতে হবে ভেতর থেকে। আর তার মাধ্যম হচ্ছে সাইকায়াট্রিক ড্রাগ।
লেখক এমন একটা ড্রাগের কথা এইখানে কল্পনা করেন, যা প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ডোজে নিলে মানুষ ‘সুখী’ হবে। বাজারে চলতি ড্রাগুগুলোর মত এটা মানুষের কর্মক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না।
এইভাবে মানুষকে সুখের সন্ধান দিতে পারলে মানুষ কোন রকম কোন অপরাধ করবে না। ফলে, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা—এইসবের আর কোন দরকার হবে না আমাদের। আমরা আরো প্রোডাক্টিভ ক্ষেত্রে আমাদের ফোর্সগুলোকে কাজে লাগাতে পারবো।
এখানে দুটো সমস্যা। এক, এরকম কোন ড্রাগ এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি যা আপনাকে সুখ দিবে, কিন্তু বিনিময়ে আপনার শরীর বা মন থেকে কিছু শুষে নিবে না।
আর দুই, সুখ আর সুখানুভূতি এক জিনিস না। লেখক এখানে যে জিনিসটার কথা বলসেন—সেটা হল সুখানুভূতি। ইংরেজিতে যাকে বলে Pleasure. ডোপামিন, সেরোটোনিনের নিঃসরণ। আর এই নিঃসরণ পার্মানেন্ট কিছু নয়। খুবই ক্ষণস্থায়ী। মানুষের ইতিহাস যতো পুরানো, নেশার ইতিহাসও ততো পুরানো। নেশাদ্রব্য যুগ যুগ ধরেই আমাদের সুখানুভূতি দিয়ে আসছে। কিন্তু সুখ দিতে পারে নাই।
বিবর্তনও আমাদের ঐভাবেই তৈয়ার করসে যেন আমরা বেশিক্ষণ সুখী হতে না পারি। বেশি সুখী হলেও সমস্যা আছে। সেক্স করে আমরা যেমন সুখ পাই। ঐ সুখটুকু না পেলে কেউ হয়তো সেক্স করতোই না। ফলে বাচ্চা হত না, বাচ্চা হত না, বাচ্চা হত না। প্রজাতি হিসেবেও আমরা টিকে থাকতে পারতাম না।
কিন্তু সেক্স করে আমরা যদি কন্টিনিউয়াসলি সুখ পেতেই থাকতাম, তাহলে মানুষ দিনরাত সেটাই করতো। খাদ্যের সন্ধানে আর বাইরে বেরোতো না। সুখের ফাঁদে পড়ে না খেয়ে মারা পড়তো গোটা প্রজাতি।
আর মানুষের মস্তিষ্কও এমন সে একটা নির্দিষ্ট মাত্রার বেশি ডোপামিন, সেরোটোনিন নিঃসরণ করতে পারে না। কাজেই, যতো সুখের ঘটনাই হোক, আমরা একটা নির্দিষ্ট মাত্রার বেশি সুখী হতে পারি না।
ধরেন, একদিন সকালে আপনি লাখ টাকা স্যালারির চাকরি পেলেন। দুপুরে আপনার বোন মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষার ফল হল। সে চান্স পেয়েছে। বিকালে বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়াকে ওয়ানডেতে নির্মমভাবে হারালো। আর রাতের বেলা আপনার পুরানো গার্লফ্রেন্ড আপনার কাছে ফিরে এল।
চার চারটা দারুণ ঘটনা ঘটলো একই দিনে। এতোগুলো না ঘটে যদি একটা ঘটতো—তাহলে আপনি যতোটুকু সুখী হতেন, চারটা ঘটায় কি আপনি চারগুণ সুখী হবেন? মস্তিষ্ক থেকে চারগুন ডোপামিন, সেরোটোনিনের ক্ষরণ হবে? উত্তর হচ্ছে, না। আমাদের মস্তিষ্ক তো আর পারপেচুয়াল মেশিন না রে ভাই। এটা একটা লিমিটেড কোম্পানি যন্ত্র।
ড্রাগগুলো এক সময় আর কাজ করে না কেন? আপনাকে কেন আগের চেয়ে বেশি ড্রাগ নিতে হয় ঠিক আগের সেই অনুভুতিটা পাওয়ার জন্য? কারণ, শুরুতে ঐ ড্রাগ যে পরিমাণ ডোপামিনের নিঃসরণ ঘটিয়েছিল, অধিক ব্যবহারে তার কর্মদক্ষতা কমে যায়। সেইম নিঃসরণ ঘটাতে আগের চেয়ে বেশি ডোজ লাগে।
এইখানে আবার আমরা সেই কানাগলিতে চলে আসি। সুখ আসলে কী? সুখ কি আমরা যে মুহূর্তগুলোতে সুখী ছিলাম, সেই মুহূর্তগুলোর যোগফল? নাকি অন্য কিছু?
নোবেল বিজয়ী অর্থনিতিবিদ ড্যানিয়েল কানম্যান বলেন, অন্য কিছু। তিনি হিসেব কষে দেখান, যে বিষয়গুলা মানুষকে সবচেয়ে বেশি পেইন দেয়, সেগুলাই বিগ পিকচারে মানুষকে সুখী করে তোলে।
বাচ্চা মানুষ করা যেমন। খুবই পেইনফুল একটা কাজ। কিছুক্ষণ পর পর ন্যাপি বদলাও। বাচ্চার জন্য আলাদা খাবার বানাও। রাতে ঘুম ভেঙে কান্নাকাটি করলে তাকে কোলে নিয়ে হাঁটো। সোজা কথা, আপনার সুখ-শান্তি সব হারাম করে নিবে সে। তারপরও মানুষ বাচ্চা নেয়। আর জিজ্ঞেস করলে দাঁত বের করে হেসে বলে, এই বাচ্চাই তার জীবনের একমাত্র সুখ। অথচ পাটিগণিতের হিসাবে এই বাচ্চার হাসিমুখ তার জীবনে যতোটা না সুখময় মুহূর্ত এনেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি দিয়েছে প্যারাময় মুহূর্ত।
প্যারাডক্সটা এইখানেই। মানুষের জীবন যোগ বিয়োগের ফর্মুলায় চলে না। মানুষ তার জীবনের কিছু লক্ষ উদ্দেশ্য তৈরি করে নেয়। ঐ উদ্দেশ্য পূরণের জন্য সে যে কোন কষ্ট মেনে নিতে রাজি। নীৎসেও ঠিক এই কথাটাই বলসেন। মানুষের জীবনে একটা মিনিং থাকা দরকার। মিনিং থাকলে কোন কষ্টই কষ্ট না। আর মিনিং না থাকলে সমস্ত রকম ম্যাটেরিয়াল সুযোগ সুবিধাও আপনাকে ভয়াবহ রকম অসুখী করে তুলবে।
মিনিং এর কথা যখন উঠলো… বিজ্ঞান কিন্তু বলে, আমাদের মানব জীবনের কোন মিনিং নাই। আমরা অন্ধ বিবর্তনের একটা ফলাফল মাত্র। আমি আপনি মারা গেলে এই মহাবিশ্বের কিছুই আসবে যাবে না। সে তার মত করে চলতেই থাকবে। প্রকৃতির কাছে আমার যা দাম, একটা গরু, গাধা বা উটপাখিরও তাই দাম।