তাই বলে আমাদের রিল্যাক্স হবার কোন সুযোগ নেই। ১৮৭১-১৯১৪ সাল পর্যন্ত ইউরোপ অনেক ঠান্ডা ছিল। অনেকেই ভেবেছিল, যুদ্ধবিগ্রহের যুগ বুঝি শেষ হয়ে আসছে। কিসের কী? এর পরপরই ইউরোপ আর ইউরোপের মারফত গোটা বিশ্বকে দু দুটো বিশ্বযুদ্ধের ঘা সইতে হল।
এখন তো তবু সেই ইতিহাস লেখার কেউ আছে। আরেকটা বিশ্বযুদ্ধ হলে সেই ইতিহাস লেখার জন্য কেউ থাকবে কিনা সন্দেহ।
১২. সুখ কী
সুখ কী?
কোথায় পাইবো তারে? কেমনে পাইবো তারে?
কবি, সাহিত্যিক, ফিলোসফার আর ধর্মগুরুরা যুগে যুগে এ প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করেছেন। এখনো করে যাচ্ছেন।
ইতিহাসবিদরা কখনো এই প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামান নাই। ব্যাবিলনের মানুষ বেশি সুখী ছিল না বাংলাদেশের মানুষ বেশি সুখী—এ নিয়ে তাদের খুব একটা কখনো কনসার্ন ছিল না।
কিন্তু এই প্রশ্নটা না করলেও সমস্যা। আমাদের সব কিছুই তখন একটা বিরাট প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়ায়। এই যে আমরা দিনরাত খেটে মরছি, কৃষিযুগ থেকে শিল্পযুগে যাচ্ছি, পৃথিবী ছেড়ে চাঁদে যাচ্ছি—এই এফোর্টের মানেটা কী? নীল আর্মস্ট্রং চাঁদের বুকে পা রাখার পর থেকে কি আমরা বেশি সুখে আছি? যদি না-ই থাকি, তাহলে বিলিয়ন ডলার খরচ করে এই রিস্ক নেবার কী অর্থ দাঁড়ালো?
বিভিন্ন আইডিওলজির মানুষ বিভিন্নভাবে সুখের সন্ধান দেন। ইসলামিস্টরা বলে, আল্লাহর পথে আসলেই সবাই সুখী হবে। ইহকালে আর পরকালে। পুঁজিবাদীরা বলে, পরকালে সুখের আশায় বসে থেকে লাভ নাই। যা সুখ, এই জনমেই নিয়ে নাও। জাতীয়তাবাদীরা বলবে, অন্যের অধীনে কোন সুখ নাই। স্বাধীনতা পেলে তবেই সুখের শুরু।
সমস্যা হল, এই হাইপোথেসিসগুলো কখনো ওভাবে পরীক্ষা করে দেখা হয়নি। মিশরের মানুষ কি ফেরাউনের সময় বেশি সুখে ছিল না ইসলাম আসার পর বেশি সুখে আছে? আলজেরিয়ার মানুষ কি ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাবার পর বেশি সুখী? এমনটা কি হতে পারে না, আলজেরীয় স্বাধীনতার চেয়ে তারা ফরাসী উপনিবেশেই বেশি ভাল ছিল? সেক্ষেত্রে তাদের এতো ঘাম ঝরানো স্বাধীনতাই তো মূল্যহীন হয়ে পড়ে।
বিজ্ঞানীরা তাই আজকাল সুখকে আর সব কিছুর মত মাপা শুরু করেছেন। সুখের সাথে তারা কতগুলো ভ্যারিয়েবলের সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা করছেন।
ভ্যারিয়েবল হিসেবে প্রথমেই আসে টাকা-পয়সার কথা। টাকা-পয়সা কী আমাদের সুখী করে? উত্তরটা হচ্ছে হ্যাঁ এবং না।
ধরা যাক, একটা জরিপ চালানো হল। জরিপের অংশ হিসেবে কতগুলো প্রশ্নের উত্তর দিতে বলা হল। সেই উত্তরগুলোর রেস্পেক্টে স্কোর এসাইন করা হল। দশের মধ্যে যার যতো স্কর, সে ততো সুখী।
এই মেজারমেন্টে একটা সমস্যা আছে। কারণ, টাকা পয়সা আমাদের একটা নির্দিষ্ট পয়েন্ট পর্যন্ত সুখ এনে দিতে পারে। এর বেশি না। যে লোকের মাসিক আয় ২৫ হাজার টাকা, সে যদি হঠাৎ একটা ৫ লাখ টাকার লটারী পেয়ে যাবে—সে আশেপাশের সবাইকে এটা বলে বেড়াবে। তার যতো ধারকর্জ সব শোধ করবে। বাচ্চাদের জন্য নতুন নতুন জামা কাপড় কিনবে। আর বউয়ের জন্য গয়না। একটা লটারী তাকে পৃথিবীর এক নম্বর সুখী মানুষে পরিণত করবে।
কিন্তু যে লোকের মাসিক আয় ১ লাখ টাকা, সে এই ৫ লাখ টাকার লটারী পেয়ে এমন কিছু আনন্দে আত্নহারা হবে না। হলেও সেটা বেশিদিন স্থায়ী হবে না।
আরেকটা ফ্যাক্টর হচ্ছে স্বাস্থ্য। আপনার যদি কঠিন কোন রোগ ধরা পড়ে, আপনি স্বভাবতই মন খারাপ হবে। সেই রোগের মাত্রা যদি দিনকে দিন বাড়তে থাকে, আপনার সুখ-শান্তিও সব পালাবে। কিন্তু এমনটা যদি না হয়? আপনার ডায়বেটিস ধরা পড়লো। কয়দিন আপনার খুব মন মেজাজ খারাপ থাকলো। আস্তে আস্তে একে আপনি মেনে নিতে শিখবেন। আপনার জীবনযাত্রার অংশ হয়ে দাঁড়াবে এই ডায়বেটিক। ডায়বেটিক হবার বছরখানেক পরের আপনি হয়তো ডায়বেটিক পূর্ব আপনির চেয়ে খুব বেশি অসুখী হবেন না।
এই সব কিছুকে ছাপিয়ে যায় আরেকটা জিনিস। সেটা হল আপনার পারিবারিক সামাজিক জীবন। যে কারণে দেখা যায়, ভাঙা পরিবারের সন্তানদের চেয়ে স্ট্রং বন্ধনওয়ালা পরিবারের ছেলেমেয়েরা অনেক বেশি সুখী হয়।।
বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটিকে তাই এখনো গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। সঙ্গীর সাথে ভালো রিলেশনকে x অক্ষে রেখে y অক্ষে সুখকে প্লট করলে আপনি প্রায় সব সময়ই পজিটিভ ঢালওয়ালা একটা সরলরেখা পাবেন। এজন্যই একজন গরিব রিকশাওয়ালা, যার বউ তাকে ভালোবাসে, সে একজন সন্দেহবাতিক বিলিওনিয়ারের চেয়ে হ্যাপিনেস ইনডেক্সে অনেক বেশি এগিয়ে থাকে।
তার মানে এই না যে—অর্থ, স্বাস্থ্য আর ভালোবাসা—এই তিনটা ভ্যারিয়েবল দিয়েই আমরা এ্যাকিউরেটলি সুখ মেজার করে ফেলবো।
দিনশেষে সুখ আপেক্ষিক। পুরোটাই নির্ভর করে আপনি কী চাচ্ছেন আর কী পাচ্ছেন—তার উপর। যে ছেলেটা কোন সাবজেক্টে ল্যাগ না খেলেই খুশি, 3 এর পরে দশমিকের ঘরে কী আছে—আর খুলেও দেখে না। আর যে 4 পাবার স্বপ্ন দেখে, তার জন্য 3.98-ও অনেক মন খারাপ করা একটা রেজাল্ট। যার সারা জীবনের স্বপ্ন একটা বাইক কেনা, সে বাইক কিনেই বিরাট খুশি। সাঁ সাঁ চালিয়ে পুরো রাস্তা মাতাবে। আর যার সারা জীবনের স্বপ্ন ব্র্যান্ড নিউ ফেরারী, সে হয়তো টয়োটা কিনে প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে বাসায় এসে ঘুমাবে। ভাববে, কী করলাম জীবনে?