আজ মানুষ যুদ্ধে যতোটা না মারা যাচ্ছে, তার চেয়ে বেশি মারা যাচ্ছে অন্য কারণে। ২০০০ সালের একটা পরিসংখ্যান দিই। এই বছর প্রায় ৩ লাখ মানুষ পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধে মারা যায়। সন্ত্রাসীদের হাতে মারা পড়ে আরো ৫ লাখের মত।
প্রতিটা মৃত্যুই দুঃখজনক। আমি জাস্ট একটা সংখ্যার মত করে মৃত্যগুলো লিখে যাচ্ছি। যার হারায়, সে বোঝে। একটা মৃত্যু মানে একটা ফ্যামিলি ধ্বংস হয়ে যাওয়া। একসাথে অনেকগুলো স্বপ্নের মৃত্যু ঘটা।
আবেগটুকু বাদ দিয়ে আমরা যদি ঈশ্বরের মত উদাসী চোখে এই মৃত্যুগুলো দেখি, তবে দেখবো, সে বছর গোটা দুনিয়ায় যতো মানুষ মারা গেছে তার মাত্র দেড় পার্সেন্ট মারা গেছে এই যুদ্ধ আর সন্ত্রাসী হামলায়। ঢের বেশি মানুষ মারা গেছে অন্য কারণে। ১২ লাখ মৃত্যু ঘটেছে গাড়ি দুর্ঘটনায়। আত্নহত্যা করেছে প্রায় ৮ লাখ।
এতো গেলো ৯/১১’র আগের কথা। ৯/১১’র পর তো অবস্থা আরো খারাপ হবার কথা। এট লিস্ট, যুদ্ধে মৃত মানুষের সংখ্যা হু হু করে বাড়ার কথা। মজার ব্যাপার হল, ২০০২ সালের পরিসংখ্যান বলে উলটো কথা। যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা এ বছর কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭২ হাজারে। এদিকে, আত্নহত্যা করে ওপারে গেছে ৮লাখ ৭৩ হাজার লোক।
আমেরিকা আমাদের যতোই সন্ত্রাসী হামলায় মরার ভয় দেখাক না কেন, সত্যিটা হচ্ছে—আইসিস বা কোন সন্ত্রাসির হাত নয়, আপনার নিজের হাতে নিজে মরার সম্ভাবনা এখন অনেক বেশি।
মধ্যযুগ পর্যন্ত পরিস্থিতি এমন ছিল না। রাতে ঘুমাতে গেলেন। পাশের গোত্রের লোক এসে আপনাদের আক্রমন করে গোটা গ্রাম কচুকাটা করে ফেললো। ঘুমের মধ্যেই আপনি পটল তুললেন। মরার আগে আজরাইলের সাথে ঠিকমত দেখা সাক্ষাতেরও সুযোগ পেলেন না:/
মধ্যযুগের ইউরোপে প্রতি ১ লাখ লোকে ২০ থেকে ৪০ জন মারা যেত সহিংসতার শিকার হয়ে। আজকে গোটা পৃথিবীতেই এই এভারেজ কমে এসেছে। ১ লাখ লোকে আজ নয় জনের মত মারা যায় সহিংসতায়। তাও সোমালিয়া আর কলম্বিয়ার মত দেশিগুলোর জন্য এই এভারেজ এতো বেশি।। তা না হলে আরো কম হত। ইউরোপের দেশগুলোতে আজ ১ লাখ লোকে মাত্র ১ জন মারা যায় সহিংসতায়।
আমাদের এই অধঃপতনের কারণ কী? আমরা এখন আর কথায় কথায় যুদ্ধ করতে চাই না কেনো? আমাদের পূর্বপুরুষদের গায়ে যে জোশ ছিল, আমাদের গায়ে সেই জোশ নাই কেন?
একটা বড় কারণ হচ্ছে রাষ্ট্রের জন্ম। রাষ্ট্রকে আমি সবসময়ই সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী বলি। তবে বিস্তীর্ণ এলাকায় ছোট ছোট অনেক সন্ত্রাসী থাকার চেয়ে একটা বড় সন্ত্রাসী থাকা ভালো। চাঁদা বা ট্যাক্স—যাই দিই না কেন, ঐ এক সন্ত্রাসীকেই দিলাম। এই বড় সন্ত্রাসীর ভয়ে বিচ্ছিন্ন ভায়োলেন্সগুলো আগের চেয়ে অনেক কম হয়। বিশ্বাস না হলে আমাজনের জঙ্গলের আদিবাসীদের দেখে আসতে পারেন। ওদের পুরুষদের অর্ধেকের মত মারা যায় নিজেদের মধ্যে খুনাখুনি করে। কী নিয়ে মারামারি? সেই তো টিপিক্যাল নারী আর জমিজমা নিয়ে।
আরেকটা কারণ যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। নোবেল শান্তি পুরস্কার যদি একজনকে দিতে হয়, তবে সেইটা রবার্ট ওপেনহেইমার আর তার দলকে দেয়া উচিত। ইনারা পারমাণবিক বোমা বানায়ে এক অর্থে লার্জ স্কেলে যুদ্ধ বন্ধ করে রাখসেন। পরাশক্তিগুলা ভালো করেই জানে, নিউক্লিয়ার যুদ্ধে যাওয়া মানে দল বাইঁধা আত্নহত্যা করা। কী দরকার?
যুদ্ধের খরচাপাতিও আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। আগেকার দিনে রাজারা যুদ্ধ করে নিজেদের আয়-ইনকাম বাড়াতো। আলেকজান্ডার থেকে শুরু করে সুলতান মাহমুদ, চেঙ্গিস খান—সবাই এক ফর্মুলাতেই নিজেদের সম্পদ বাড়াইসে। লুটের মাল দিয়ে। অধিকৃত এলাকার সোনা-দানা, গরু-ছাগল, শস্য—এইসব লুট করে।
আজকের দিনে এমনটা করে কোন লাভ নাই। আজকের দিনের সম্পদ সিন্দুকে সোনা-দানার আকারে লুকায়ে রাখা নাই। আজকার সম্পদ আছে মানুষের মগজে, কম্পিউটারের চিপে। ধরেন, চায়নার হঠাৎ মতি হইলো ক্যালিফোর্নিয়া দখল করবে। ক্যালিফোর্নিয়ার আয়ের উৎস কী? সিলিকন আর সেলুলয়েড। যার পেছনের কারিগর গুগলের প্রোগ্রামাররা। হলিউডের শব্দশিল্পীরা। চায়না ক্যালিফোর্নিয়া দখল করে কী লুট করবে? হাজার হাজার স্ক্রিপ্ট আর লাখ লাখ হার্ডডিস্ক? তার আগেই দেখা যাবে এই প্রোগ্রামার আর শব্দশিল্পীরা মুম্বাই বা দুবাইর প্লেনে চড়ে সেইখানে গড়ে তুলেছে নতুন হলিউড, নতুন সিলিকন ভ্যালী।
সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটা ঘটসে অবশ্য আমাদের মানসিকতায়। সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বললে, আমাদের শাসকদের মানসিকতায়। হুন রাজাই হোক আর আজটেক ইমামই হোক, যুদ্ধকে সবাই সৌভাগ্যের চিহ্ন হিসেবে দেখতো। কেউ ক্ষমতায় যাবার সিঁড়ি হিসেবে, কেউ ক্ষমতা সংহত করার উপায় হিসেবে। যারা এটাকে ভালো চোখে দেখতো না, তারাও মেনে নিত যে জন্ম, মৃত্যু আর বিবাহের মতই যুদ্ধ অনিবার্য। কাজেই, যুদ্ধ থেকে আমরা যা শিখতে পারি, সেটাই লাভ।
আজকাল অস্ত্রের ব্যবসায়ী ছাড়া কেউ যুদ্ধকে এভাবে দেখে না। রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, শিল্পী-বুদ্ধিজীবী—সবাই আজ শান্তি চায়। সবচেয়ে বেশি করে চায় ব্যবসায়ীরা। আর পুঁজি যেহেতু এই নিওলিবারেল পৃথিবীর ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থা করতেসে, প্রায় সব দেশেই এখন রাজাদের ব্যবসায়ী মহলের কথায় চলতে হয়। এতে আর কিছু না হোক, যুদ্ধের ফ্রিকোয়েন্সি অনেক কমে এসেছে।