সে যাই হোক। দিন, সপ্তাহ, মাস কিংবা বছরের ধারণা সে সময়েও ছিল। এ সময়েও আছে। পরিবর্তনটা ঘটসে কোয়ান্টিফিকেশনে। ঘড়ি ধরে সময় বলা বা সংখ্যা ধরে বছর গণনার ধারণা তখন ছিল না। আপনি যদি টাইম ট্রাভেল করে মধ্যযুগে গিয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করেন, ভাউ, এটা কোন সাল—সে আপনার কব্জির ঘড়ি কিংবা হাতের মোবাইল দেখে যতোটা বিস্মিত হবে, এই প্রশ্ন শুনেও ঠিক ততোটাই ভড়কে যাবে।
ঘড়ি ধরে সময় গণনার জন্ম হইসে শিল্প বিপ্লবের পর পর। আধুনিক ঘড়ি শিল্প বিপ্লবের সন্তান। মধ্যযুগের একজন জুতো নির্মাতার কথা ধরেন। সে তার জুতার সোল থেকে শুরু করে বাকল পর্যন্ত সবই নিজে বানাতো। সে যদি কোন একটা ধাপে একটূ বেশি সময় নেয়ও, তাতে অন্যদের কোন লাভক্ষতি হত না।
বিপ্লবের পর এই চেহারাটা বদলে যায়। অনেকগুলো মেশিনে করে হাজার হাজার জুতার পার্টস পার্টস করে বানানো হচ্ছে। এখন কোন একটা মেশিনের শ্রমিকের চোখে যদি সামান্য ঝিমুনি আসে কিংবা দেরি করে তার ওয়ার্ক স্টেশনে আসে, তার পরের স্টেশন, তার পরের স্টেশন এবং তার পরের স্টেশন—সবারই কাজে লেট হবে।
এই সমস্যার সমাধান কী?
সবাইকে ঘড়ি ধরে একই সময়ে আসতে বলা। খিদে পাক বা না পাক, সবাইকে একই সময়ে খেতে বাধ্য করা। চার্লি চ্যাপলিনকে যেমন করা হইসিলো Modern Times ছবিতে। আর কারো যদি কাজ ভালো লেগেও যায়, সে যদি আরো কাজ করতেও চায়– তবুও তাকে এবং তার সাথের সবাইকে একই টাইমে বিদেয় করে দেয়া।
কারখানাগুলো তাদের এরকম টাইমেটেবিল চালুর পর থেকেই আস্তে আস্তে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও একে ফলো করা শুরু করে। স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল—সব খানে মানুষ নয়, সময় আর ঘড়ি রাজত্ব করা শুর করে। এমনকি যেখানে এ্যাসেম্বলি লাইনের কিছু নাই, সেখানেও এই ঘড়িই রাজা হয়ে বসে। কারখানা যদি বন্ধ হয় পাঁচটায়, শুঁড়িখানা চালু হয় ৫টা ২ এ।
ও। আরেকটা সেক্টর তো বাদই পড়ে গেছে। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট। কারখানার শিফট শুরু আটটায়। তার মানে ৭টা ৫৫তে সব শ্রমিককে ফ্যাকটরি গেটে নামিয়ে দিতে হবে। তা না হলে একে তো প্রডাকশনের ক্ষতি হবে, ওদিকে শ্রমিকদের বেতন কাটা যাবে।
১৭৮৪ সালে ব্রিটেনে প্রথমবারের মত পাবলিক ট্রান্সপোর্ট চালু হয়। ঘোড়ার গাড়িতে করে মানুষ আনা নেয়া। তখন খালি গাড়ি কখন ছাড়বে, সেটা শুধু বলা থাকতো। কখন পৌঁছাবে—তা কেউ জানে না। এর কারণও ছিল। একে তো ঘোড়ার গাড়ি মাশাল্লা স্লো। একবার রওনা দিয়ে কখন পৌঁছাবে—তা ঘোড়ার মর্জির উপর নির্ভর করে। এদিকে প্রতিটা শহরের তখন নিজস্ব লোকাল টাইমটেবিল ছিল। লন্ডনে যখন দুপুর ১২টা, লিভারপুলে তখন ১২টা ২০। ক্যান্টাবেরিতে ১১টা ৫০।
লিভারপুল আর ম্যানচেস্টারের মধ্যে প্রথম কমার্শিয়াল ট্রেন সার্ভিস চালু হয় ১৮৩০ সালে। দশ বছর পর প্রথম ট্রেন টাইম স্কেজিউল ইস্যু করা হয়। তখন আরেকটা সমস্যা দেখা দেয়। এই ট্রেনগুলো ছিল ঘোড়ার গাড়ির চেয়ে অনেক ফাস্ট। কাজেই, এক শহর থেকে আরেক শহরে যেতে সময়ের হিসাব উলটা পালটা হয়ে যাচ্ছিল। লিভারপুল থেকে ১২টা ২০ এ রওনা দিয়ে আপনি লন্ডনে এসেও যদি দেখেন ১২টা ২০ ই বাজে তাইলে ক্যাম্নে কী?
এই সমস্যার সমাধান করার জন্য ট্রেন কোম্পানির মাথারা সব একসাথে বসলেন। তারা গ্রীনিচ মানমন্দিরের সময়ের সাথে সকল ট্রেনের স্কেজিউল সিনক্রোনাইজ করে নিলেন। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও আস্তে আস্তে এই টাইমটেবিলই জীবন যাপন করা শুরু করলো। পঞ্চাশ বছর পর ব্রিটিশ সরকার আইন পাশ করে যে, সকল প্রতিষ্ঠানকে গ্রীনিচ টাইম অনুসরণ করে চলতে হবে।
সেই থেকে আমরা সুর্যোদয়-সূর্যাস্তের ন্যাচারাল সময় নয়, সরকারের বেঁধে দেয়া সময় নিজেদের অভ্যস্ত করে নিতে শুরু করেছি।
ঘড়ি নিয়ে একটা মজার ঘটনা দিয়ে লেখাটা শেষ করি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেন তো স্বাধীন ছিল। তো বিবিসি নিউজ নাৎসী আক্রান্ত ইউরোপেও প্রচারিত হত। প্রতিটা নিউজ প্রোগ্রাম শুরু হত বিগ বেনের আওয়াজ দিয়ে। (বিগ বেন লন্ডনের বিখ্যাত ঘড়ি)। এই আওয়াজ আবার ছিল লাইভ। মানে সত্যি সত্য ঘন্টি বাজিয়ে টেলিকাস্ট শুরু হত।
এখন জার্মান বিজ্ঞানীরা তো বস। এরা এক আওয়াজ থেকে আরেক আওয়াজকে ডিফারেনশিয়েট করতে পারলো। তা দিয়ে লন্ডনের আবহাওয়া কেমন, আজকে রাতে এ্যাটাক করার জন্য উপযুক্ত কিনা—এইসব তথ্য বের করে ফেলতো। ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিস যখন এটা জানতে পারে, তখন তারা লাইভ ডিং ডং বাদ দিয়ে আগে থেকে রেকর্ড করা আওয়াজ বাজিয়ে নিউজ টেলিকাস্ট শুরু করলো।
কিন্তু এই আওয়াজটা তারা বাদ দিল না। কেননা, এই আওয়াজ ছিল স্বাধীনতার প্রতীক। মুক্তির প্রতীক।
সুখে থাকলে ভূতে কিলায়। অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় সুখে আছি বলেই আমরা ব্যাপারটাকে এ্যাপ্রিশিয়েট করতে পারি না।
কথাটা আসলে সুখ হবে না, হবে শান্তি। স্মরণকালের ইতিহাসে আমরা, পৃথিবীর মানুষেরা এই মুহূর্তে সবচেয়ে শান্তিতে আছি—এমনটা দাবি করলে আপনি হয়তো হৈ হৈ করে তেড়ে আসবেন। বলবেন, ইরাকের মানুষকে আপনি দেখেন না? কিংবা ফিলিস্তিনে আপনার চোখ যায় না?
মনে রাখতে হপবে, এগুলো কিন্তু এক্সেপশন। এক্সেপশনগুলোই পত্রিকার পাতার লীড নিউজ হয়। ভারত বা চায়নায় যে শ শ কোটি মানুষ যুদ্ধ ছাড়াই দিব্যি শান্তিতে ঘুমাতে যাচ্ছে-সেটা কখনো পত্রিকার নিউজ হবে না।