Shopaholic শব্দটা তাই এমনি এমনি আসে নি। আমাদের ধর্মীয়, সামাজিক—সমস্ত উৎসবের কেন্দ্রে এসে দাঁড়িয়েছে এই কনজ্যুমারিজম। ক্রিসমাসকে বলা হয় পৃথিবীর বৃহত্তম শপিং ফেস্টিভ্যাল। Memorial Day নামে একটা দিবস আছে আমেরিকায়। যুদ্ধে নিহত সৈন্যদের স্মরণে। আমেরিকানরা এটাকেও শপিং উৎসব বানিয়ে ফেলেছে। খুব কম আমেরিকানই আজ এই দিনের ইতিহাস তাৎপর্য জানে। তাদের কাছে এটা আর দশটা উৎসবের মতই একটা উৎসব যেদিন কেনাকাটায় অনেক ছাড় পাওয়া যায়। মানুষ কার্ট ভরে শপিং করবে—যীশু বা ঐ সৈন্যরা নিশ্চয়ই এই আশায় নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেনি।
কনজ্যুমারিজমের থাবা আমাদের সংস্কৃতিতেও কি পড়ছে না? পড়ছে। এবং খুব ভালোভাবেই পড়ছে। আপনি হয়তো নতুন প্রজন্মকে নিয়ে হতাশ হতে পারেন—এরা স্বাধীনতা দিবস আর বিজয় দিবস গুলিয়ে ফেলে। কোনটা শহীদ দিবস আর কোনটা ভালবাসা দিবস—তার পার্থক্য করতে পারে না।
সত্যিটা হচ্ছে—ভোগবাদ যখন একোটা সমাজে আস্তে আস্তে শেকড় গাড়া শুরু করে, তখন তার কাছে আলাদা কোন উৎসবের তাৎপর্য থাকে না। সবকিছুই তখন তার কাছে কেনাকাটার, মৌজ করার একটা উপলক্ষ মাত্র। যে বাচ্চাটা তার বড় ভাই/বোনকে দেখছে, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২১শে ফেব্রুয়ারী কিংবা ২৬শে মার্চ—তারিখ যাই হোক না কেন, তারা শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে হাসিমুখে বেরোচ্ছে, খাচ্ছে, ছবি তুলছে—তখন তার কাছে আপনি ইতিহাসের পাঠ কীভাবে পৌঁছাবেন? মানুষ তো বই পড়ে ইতিহাস জানে না। জানে বর্তমান থেকে। প্র্যাক্টিক্যালী দেখে।
ভোগবাদ যতো বাড়বে, নতুন প্রজন্মও পাল্লা দিয়ে ইতিহাস থেকে, তার শেকড় থেকে ততো দূরে সরে যাবে—খুব তিতা হলেও এটাই সত্য। এটাই নিয়তি।
কনজ্যুমারিজমের আর মাত্র দুটো উদাহরণ দিয়ে শেষ করবো।
পশ্চিমে মদ্যপান হালাল। এতে তাদের দুটো লাভ হচ্ছে। মদের বিক্রি হচ্ছে। এদিকে হার্টের ডাক্তারের চেম্বারে লাইনও বাড়ছে। এক ঢিলে দুই ইন্ডাস্ট্রির লাভ।
আরেকটা লাভ হচ্ছে পিজা, বার্গার—এইসব বেঁচে। লোকে পিজা খেতে খেতে ফুলছে। স্থূলত্ব নামের এক মহামারী দেখা দিচ্ছে গোটা মহাদেশে। আবার সেই স্থূলত্ব নিরাময়ের জন্য লোকে ডায়েটিশয়ানের কাছে যাচ্ছে। ডায়েট চার্ট নিচ্ছে। আবারও দুটো ইন্ডাস্ট্রির লাভ।
এই ক্যাপিটালিস্ট-কনজ্যুমারিস্ট কমপ্লেক্সের সবচেয়ে বড় বিজয়টা অবশ্য অন্যখানে। ইতিহাস জুড়েই মানুষ এমন সব জীবনধারার অনুসারী হয়ে এসেছে, যা সে কখনোই ঠিকমত ফলো করতে পারে নি। খ্রিস্টানরা যীশুর দেখানো পথে চলেনি। মুস্লিমরাও নবীর দেখানো পথ থেকে সরে এসেছে।
কনজ্যুমারিজমই সম্ভবত প্রথম ধর্ম, যে ধর্মের নবীরা আমাদের যা করতে বলেন, আমরা ঠিক তাই করি। এতো চমৎকার অনুসারির দল আর কোন নবী পেয়েছেন কিনা সন্দেহ। মুসা আর ঈসা যদি স্টিভ জবসকে খানিক ঈর্ষা করেও থাকেন—এতে অবাক হবার কিছু নেই।
ন্যাচারাল সাইকেল বলে একটা ব্যাপার ছিল কৃষিযুগে। এখনকার মত সেকেন্ড ধরে সময় গণনার কোন উপায় ছিল না তখন। মানুষজনের তেমন কোন আগ্রহও ছিল না এই ব্যাপারে। জানেই তো কোন সময় বীজ বুনবে আর কোন সময় সেটা ফসল হয়ে ঘরে উঠবে।
তাই বলে যে দিন, মাস, সপ্তাহের কোন আইডিয়া ছিল না—তা না। ব্যাবিলনীয়রা যেমন চান্দ্রমাসের হিসাব রাখতো। এই চক্রের প্রথম দিনে চাঁদের সামান্য আভাস দেখা যায়। সাত দিন পর দেখা যায়, চাঁদটা একটা অর্ধগোলাকৃতি রূপ নিয়েছে। আরও সাত দিন পর আমরা পূর্ণ চন্দ্রের দেখা পাই। এইভাবে প্রায় আরো সাত দিন পর চাঁদটা আবার ছোট হয়ে অর্ধগোলকের রূপ নেয়। প্রায় আটাশ দিনের দিন বেচারী সম্পূর্ণ উধাও হয়ে যায়।
‘প্রায়’ বলছি এই কারণে যে চাঁদ বেচারী মানুষের পাতানো এই হিসাব পুরোপুরি ফলো করতো না। যে কারণে ঠিক চার সপ্তাহে কখনো এক মাস হয় না। ব্যাবিলনীয়রা এজন্য করতো কি—মাসের তিন সপ্তাহ হত ওদের সাত দিনে। লাস্ট সপ্তাহটা আট কি নয় দিনে হত। সিঙ্ক্রোনাইজ করার জন্য। যেন পরের মাসের প্রথম দিনটা আবার নতুন চাঁদ দিয়ে শুরু হয়।
সাত দিনে কেন সপ্তাহ, দশ দিনে বা বার দিনে কেন নয়—তার একটা মোটামুটি আইডিয়া পাওয়া গেলো। সাত নম্বর দিনটাকে ব্যাবিলনীয়রা পবিত্র দিন হিসেবে গণ্য করতো। এই দিন অন্য সব কাজকর্ম নিষেধ ছিল। এই দিন তুমি রেস্ট নিবা আর দেবতার এবাদত করবা।
সপ্তম দিনের এই ব্যাপারটাকে ইহুদীরা বলে Sabbath. Black Sabbath নামে একটা রক ব্যান্ডও আছে। এই Sabbath শব্দের আক্ষরিক অর্থই Day of rest. বিশ্রামের দিন। ঈশ্বর ছয় দিনে পৃথিবী বানিয়ে সাত দিনের দিন রেস্ট নিসিলেন। কাজেই, আমাদেরও সাত দিনের দিন রেস্ট নেয়াটা আসে আর কি:D
তারপরও কথা থেকে যায়। সাত দিনের সপ্তা তো ইহুদীদের চর্চা। ক্ষমতা তো ইহুদীদের হাতে ছিল না। ক্ষমতা ছিল প্যাগান রোমানদের হাতে। রোমানদের সপ্তাহ সাত দিনে ছিল না। তাদের সপ্তাহ ছিল আট দিনে। দিনগুলোর নাম অক্ষর দিয়ে রাখা হত। সপ্তাহ শুরু হত A দিয়ে। আর শেষ হত H দিয়ে। (Holiday শব্দটার জন্ম কি এই H থেকেই?)
অষ্টম দিনের দিন রোমের বাজার গরম হয়ে উঠতো। সবাই কেনাবেচা করতে বাজারে ছুট দিত। দীর্ঘদিন এই নিয়মই চালু ছিল। সম্রাট কনস্টান্টাইন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের মধ্য দিয়ে দুনিয়ার ইতিহাসে অনেকগুলো স্থায়ী পরিবর্তন আনসেন। তার মধ্যে একটা হল আট দিনের জায়গায় সপ্তাহকে অফিশিয়ালী সাত দিনের করা। আমরা কনস্টানটাইনের ধারাবাহিকতারই অনুসারী মাত্র।