এক সময় যেমন ম্যাচমেকারের মূল দায়িত্বটা পালন করতো আমাদের বাবা-মা। আর্থিক লেনদেন যতোটুকুই হতো, সেটা বৈঠক ঘরে। পিতায় পিতায়। এই লেনদেনটাই এখন বৈঠকঘর ছাড়িয়ে চলে এসেছে রেস্তোঁরা আর কফিশপে। টাকাটা এখন বাবাদের পকেটে না গিয়ে যায় সুন্দরী ওয়েট্রেসের পকেটে। রেস্তোঁরায় এলেই তো আর প্রেম করা যায় না। প্রেম করার জন্য যে মিনিমাম যোগ্যতা, সেটা অর্জন করার জন্য আমাদের যেতে হয় জিমে। ফ্যাশন ডিজাইনার আর ডায়েটিশিয়ানদের কাছে।
জিম ইনস্ট্রাক্টর কিংবা ডায়েটিশিয়ানও আমাদের বিনা পয়সায় সার্ভিসটা দেয় না। এই পয়সাটা আসে আমাদের করা ওভারটাইম থেকে। কিংবা ছুটির দিনের এক্সট্রা খাটুনি থেকে। যে সময়টুকু আমাদের পরিবারকে দেয়ার কথা ছিল, সেই সময়টুকু খোলা বাজারে সওদা করে।
বাজার অর্থনীতি এইভাবে তার দেয়া স্বাধীনতার মূল্য পুরোপুরি উশুল করে নেয় আমাদের জীবন থেকে।
একদল ইঁদুরের উপর একবার একটা পরীক্ষা করা হল। ইঁদুরগুলোকে দুটো দলে ভাগ করে বড় করা হল। একদলকে বাবা ইঁদুরের সাথে একই খাঁচায় বড় করা হল। আরেক দলকে বাবা ইঁদুর ছাড়াই বড় করা হল।
দেখা গেলো, যেসব ইঁদুর বাবা ইঁদুর ছাড়াই বড় হচ্ছে, তারা বেশি হিংস্র আর এ্যাগ্রেসিভ হয়ে ইঠছে।
মানুষের মত পশুপাখিদেরও যে স্নেহ মায়া মমতা ভালবাসার দরকার আছে, এটাই তার একমাত্র প্রমাণ না।
১৯৫০ এর দিকে মার্কিন মনস্তত্ত্ববিদ হ্যারি হার্লো বানরদের নিয়া একটা পরীক্ষা করেন। জন্মের পরপরই হ্যারি মা বানর থেকে শিশু বানরকে আলাদা করে ফেলেন। সেই শিশু বানরকে লালন পালনের ভার দেয়া হয় নকল মা বানরের উপর।
প্রতিটা খাঁচায় দুটো করে নকল মা ছিল। এক মা’র শরীর ধাতব তার দিয়ে তৈরি। তার গায়ে আবার দুধের বোতল ফিট করে রাখা হইসে যেন শিশু বানরটা তার ত্ষ্ণা মেটাতে পারে। আরেকটা মা’র শরীর কাঠের। তার উপর কাপড়-চোপড় জড়ানো। এই মা দেখতে অনেকটা আসল মা বানরের মতন।
শুধু দেখতেই। এই মা’র শরীরে খানা-খাদ্য কিছু ফিট করা ছিল না। হার্লো ভাবসিলেন, দুধ যেহেতু ধাতব মা’র কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে, বানর শিশু সারাদিন তার গায়েই পেল্টে থাকবে।
হার্লোকে অবাক করে দিয়ে বানর শিশুরা দিনের বেশিরভাগটা সময় কাপড় পরা মায়ের সাথেই কাটায়। এমনকি তারা যখন ধাতব মায়ের বুকের দুধ খায়, তখনও দুই পা দিয়ে কাপড় পরা মা-কে আঁকরে রাখে।
হার্লো ভাবলেন, বানরগুলার কি ঠান্ডা লাগতেসে? ওমের জন্য কি কাপড় পরা মাকে আঁকরায়ে ধরতেসে? উনি ধাতব মা’র শরীরের ভেতর একটা ইলেকট্রিক বাল্ব পুরে দিলেন যেন সেটা থেকে তারা তাপ পায়। দেখা গেল, এতো সুযোগ সুবিধার পরও কাপড় মা-কে তারা ছাড়ছে না।
ম্যাটারিয়েলিস্টিক চাহিদার চেয়ে সাইকোলজিক্যাল চাহিদাটাই যে বড়, এই বানর শিশুগুলো তা আবারও প্রমাণ করে ছাড়লো।
হ্যাঁ, মানুষ গাড়ি চায়, বাড়ি চায়, সবই চায়। এর পাশাপাশি সে আরেকটা জিনিস চায়। সে আরেক মানুষের সাথে বন্ধনে জড়াতে চায়। সে চায়, তাকে নিয়ে আরেকটা মানুষ ভাবুক। তার দুঃখে কাঁধে হাত রাখুক। তার ম্ত্যুর পর দু ফোঁটা চোখে জল ফেলুক। পশুপাখি হয়তো এতোটা চায় না। কিন্তু তারাও বন্ধনে জড়াতে চায়। মা-বাপ, ভাই-বোনকে নিয়ে একটা সুস্থ সোশ্যাল জীবন চায়।
আমরা ক্ষমতার জোরে তাদেরকে এই জীবন থেকে তো বঞ্চিত করছিই, সেই সাথে প্রতি বছর ৫০ বিলিয়ন প্রাণী হত্যা করে নিজেদের পেটের চাহিদা মেটাচ্ছি। অবশ্য পৃথিবীটাই এমন। একজনের সর্বনাশ করে আরেকজন তার পেটের ক্ষুধা মেটায়।
এর ফলে আমাদের একটা লাভ হইসে—যেটা খুব স্পষ্ট। আমাদের খাদ্যের পরিমাণ অনেক অনেক বাড়সে। সবাইকে এখন আর লাঙল নিয়ে মাঠে দৌড়াতে হয় না। আমেরিকাতেই তো মাত্র ২ শতাংশ মানুষ এখন কৃষিকাজ করে। ঐ ২ শতাংশই গোটা মহাদেশের খাদ্য চাহিদা মেটাচ্ছে।
বাকি ৯৮ পার্সেন্ট লোক তাহলে কী করছে? এরাই মোবাইল বানাচ্ছে, কম্পিটার বানাচ্ছে, ক্যামেরা আর ওয়াশিং মেশিন বানাচ্ছে। এই বিপুল কর্মযজ্ঞের ফলে ইতিহাসে প্রথমবারের মত আমাদের চাহিদার চেয়ে বেশি জিনিস উৎপাদিত হতে লাগলো। এর ফলে একটা নতুন সমস্যা দেখা দিল।
এতো জিনিস কিনবে কে?
আর কে কিনবে? আমার আপনার মত সাধারণ মানুষ কিনবে। আমরা না কিনলে পুঁজিবাদের চাকাটাই যে বন্ধ হয়ে যাবে। নিজ অস্তিত্বের স্বার্থেই পুঁজিবাদ আমাদের মধ্যে কেনার একটা অভ্যাস বুনে দিয়েছে। এর একটা বলিহারি নামও দিয়েছি আমরা। যাকে বলি কনজ্যুমারিজম।
ইতিহাসে বেশিরভাগটা সময় জুড়েই ছিল—Necessity is the mother of invention. এখন সেটা হয়ে দাঁড়িয়েছে—Invention is the mother of necessity. কাল বাজারে আইফোনের একটা নতুন মডেল আসুক। আমরা অনেকেই চোখ বন্ধ করে সেটা কিনতে লাইন দেব। নতুন কী ফিচার যোগ হল—সেটা না জেনেই।
আমরা দরকারি জিনিস কিনছি। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে কিছি এমন জিনিস যা আমাদের না হলেও চলতো। কেন? স্রোতের সাথে থাকার জন্য। পাঁচজন মিলে যখন আড্ডা মারছি, তখন দেখা যায় বাকি চারজন আইফোনের নতুন ফিচার নিয়ে আলাপ করছে। পঞ্চম ব্যক্তিটিকে তখন জোয়ির মত মুখ হাঁ করে বসে থাকতে হয়। না বুঝেই মাথা নাড়তে হয়।
আমরা কেউই এই আনইজি অবস্থায় পড়তে চাই না। আমরা চাই কমফোর্ট জোনে থাকতে। স্রোতের সাথে থাকতে। ম্যানুফ্যাকচাররা আআমদের এই ইনসিকিউরিটির খোঁজ রাখেন। বাজারে হয়তো অলরেডি প্রায় পারফেক্ট একটা মডেল আছে, তারপরও এরা বছর বছর একটা দুটো হালকা ফিচার যোগ করে নতুন মডেল ছাড়বে বাজারে। আর পাবলিকও সেটা খাবে।