হিস্ট্রি রিপিটস ইটসেলফ। দশ বছর পর একই ঘটনা ঘটেলো ইনকাদের সাথে।
জ্ঞান বা জ্ঞানের আগ্রহকে যে গ্লোরিফাই করা হয়—তা তো আর এমনি এমনি না। ইউরোপীয়দের যে জ্ঞান ত্ষ্ণাটা ছিল, অজানাকে জানার যে আগ্রহ ছিল, তার ভগ্নাংশও যদি আজটেক বা ইনকাদের থাকতো, তবে আজ হয়তো তারা ইতিহাসের পাতায় না থেকে মর্ত্যের পৃথিবীতেই থাকতো। ক্যারিবীয়দের দুর্দশার কথা জানলে হয়তো আজটেকরা আরো প্রিপেয়ার্ড থাকতো। কিংবা আজটেকদের কথা জানলে ইনকারা। কিন্তু ঐ যে, নিজেদের সীমানাকেই পৃথিবীর সীমানা ভাবা—এই দৃষ্টিভঙ্গিই তাদের সর্বনাশ করলো।
‘নলেজ ইজ পাওয়ার’, বা আজকের ভাষায় ‘ইনফরমেশন ইজ পাওয়ার’—তাই কোন তত্ত্বকথা নয়। ইতিহাস নিজেই এর বড় প্রমাণ।
১১. সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা
দুনিয়ায় সব কিছু একসাথে হয় না।
ফরাসীরা আমাদের সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা শিখাইসে। অথচ ফরাসী দেশেই সাম্য বা স্বাধীনতা—কোনটাই পুরাপুরি নাই।
ফিদেল ক্যাস্ট্রো আমাদের সাম্যের বাণী শোনান। কিন্তু নিজের দেশের মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে। স্বাধীনতার লোভে তার দেশের মানুষ তাই নব্বই মাইল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
তার দেশের মানুষ যেই ড্রীমল্যান্ডে আসে, এইখানে স্বাধীনতা আছে। কিন্তু সেটা সাম্যের বিনিময়ে। এখানকার বড় শহরগুলোতে তাই হোমলেস মানুষের সংখ্যা চোখে পড়্রা মত। এখানকার কোম্পানির সিইও আর সাধারণ এমপ্লয়ীর বেতনের পার্থক্য অশ্লীল রকমের বেশি। বাস্তু পিরামিডের সবচেয়ে উপরের মানুষ আর সবচেয়ে নিচের মানুষটার দূরত্ব এখানে দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।
ঠিক একই না হলেও কাছাকাছি ব্যাপারটা ঘটে চলেছে আমাদের পারিবারিক জীবনে।
ক্যারিয়ার ঠিক রাখতে গেলে আমরা ফ্যামিলির সদস্যদের সময় দিতে পারি না। আবার পরিবারের সাথে নিয়মিত কোয়ালিটি টাইম কাটাতে গেলে ক্যারিয়ারের বারোটা বেজে যায়।
যে লোকটাকে তাই ছুটির দিনেও বাইরে বেরোতে হয় বিদেশী ক্লায়েন্ট এ্যাটেন্ড করার জন্য, সেই এই যন্ত্রণাটা বোঝে। তার বাচ্চা মেয়েটা তাকে সারা সপ্তাহে কাছে পায় না। ছুটির দিনে মেয়ের সাথে খেলবার কথা দিয়ে যখন সে বেরোতে নেয় আর মেয়েটা তার শার্টের কোঁচা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন আমরা বুঝি—আধুনিক সময় আমাদের কী দিচ্ছে আর কী কেড়ে নিচ্ছে।
সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা বাজার—যেটাই বলেন, তার সাথে পরিবারের এই দ্বন্দ্বটা আধুনিক সময়ের সবচেয়ে বড় উপাখ্যান।
আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব পার হয়ে আসছি, কৃষি বিপ্লব পার হয়ে আসছি—সব সময়ই পরিবার আমাদের সাথে ছিল। সুতাটা একটুকুও ছিঁড়ে নাই। পরিবার থেকেই গোত্র হইসে, সম্প্রদায় হইসে, সাম্রাজ্য পর্যন্ত হইসে—কিন্তু পরিবারের কলকব্জায় সে আঘাত করতে পারে নাই।
আমরা অসুস্থ হইসি। পরিবারের সদস্যরা আমাদের সেবাযত্ন করসে। বুড়া হইসি। বাড়ি বানাবো। হাত লাগবে। পরিবার প্রতিবেশীরাই এগিয়ে আসছে। ব্যবসা করবো। লোন লাগবে। ঐ পরিবার প্রতিবেশীরাই ছিল শেষ আশ্রয়স্থল। আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি—সব কিছুর আঁতুরঘর ছিল এই পরিবার।
রাষ্ট্রীয় প্রশাসনও সামলাইসে এই পরিবার। মিং আমলে চায়নায় একটা সিস্টেম ছিল। এই সিটেমকে বলা হত Baojia সিস্টেম। দশটা পরিবার মিলে হইতো একটা Bao। আর দশটা Bao মিলে তৈরি হত একটা Jia। Bao এর এক সদস্য কোন অন্যায় করলে অন্যদেরও তার শাস্তি পেতে হত। স্পেশালী Bao এর মুরুব্বিদের। ট্যাক্সও ঐ মুরুব্বীরাই কালেক্ট করতো। বুড়োরা তো জানতো, কোন পরিবারের আয় কেমন। ঐ অনুযায়ী ট্যাক্সের রেট ঠিক করে দিত। এতে একটা বিশাল সুবিধা হইসিলো মিং রাজাদের। বেতন দিয়ে হাজার হাজার ট্যাক্স কালেক্টর পোষা লাগে নাই তাদের। পরিবারগুলোই প্রশাসন সামলাইসে।
তার মানে এই না যে—পরিবার ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা মাত্রই সুখস্বর্গ। ১৭৫০ সালের এক মানুষের কথা চিন্তা করেন। তার বাপ-মা দুইজনই মারা গেলে তাকে রীতিমত পথে বসতে হতো। অনেক সময় গোত্রও তার দায়িত্ব নিত না। সেক্ষেত্রে সে হয় সৈন্যদলে নাম লেখাতো নয়তো বেশ্যালয়ে।
গত দুই শতাব্দীতে এই চিত্রে একটা বড়সড় পরিবর্তন আসছে। সমাজের নিউক্লিয়াস থেকে পরিবার আস্তে আস্তে সরে আসছে। শিল্প বিপ্লবের পর থেকেই রাষ্ট্র আর বাজার ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠতেসে। আর বাজার যতো স্ট্রং হচ্ছে, পরিবার, পারিবারিক মূল্যবোধ—এরা ততো দুর্বল হয়ে পড়ছে।
বাজার আমাদের ‘ইনডিভিজুয়াল’ হতে বলতেসে। বলতেসে, বাপ-মা’র কথা শোনার দরকার নাই। যেমনে খুশি জীবন কাটাও। যার সাথে খুশি জীবন কাটাও। তোমার জীবন তোমার।
মামা’জ বয়দের এখানে খুব করুণার চোখে দেখা হয়। বাজার আমাদের কানে প্রতিনিয়ত এই মন্ত্র বাজিয়ে যায়, বাপ-মা’র পায়ের নিচে পড়ে থাকার কোন মানে নাই। দরকার হইলে আমরা তোমার টেক কেয়ার করবো। আমার জন্য কাজ করো। আমি তোমার অসুখ হইলে তোমারে সারায়ে তুলবো। বাড়ি বানানোর লোন দিব। আর বুড়া হইলে পেনশন।
এই লোভে পড়ে মানুষ বাজারকে সময় দিতেসে। কিন্তু বাজারকে সময় দিতে গিয়ে দেখে, সে নিজে একা হয়ে পড়তেসে। তার কথা শোনার কেউ নাই। সুখ-দুঃখের আলাপ করার কেউ নাই। মার্কেট ইকোনমির সাথে পারিবারিক জীবনের এই দ্বন্দ্ব আমাদের রীতিমত ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছে। বায়োলজিক্যাল বাপ-মা’র ভূমিকা আজ এখানে গৌণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ রাষ্ট্র আমাদের মা। বাজার আমাদের বাপ।