সম্ভবত, নিয়েন্ডারথালদের সমাজে হায়ারার্কি বা জটিলতা সব কিছুই অনেক কম ছিল। একে অন্যের পিঠে কথা বলার রেওয়াজ তাদের মধ্যে চালু হয়নি। ফলে, তাদের ভাষাও সেভাবে ডেভেলপ করেনি। যার মূল্য তাদের দিতে হয়েছে নিজেদের অস্তিত্ব দিয়ে। আহারে বেচারারা! সময় থাকতে পরচর্চা করলে আজ ওদের এই দুর্দিন দেখতে হত না।
গল্প বলা খুব কঠিন একটা কাজ। খুব কম মানুষই এটা পারেন।
মানুষ যখন ভাষা আবিষ্কার করলো, মোটামুটি সেই মুহূর্ত থেকেই সে গল্প বলতেও শুরু করলো। আর এই গল্প বলার মধ্যে দিয়ে সে এক নতুন রিয়েলিটি তৈরি করলো তার চারপাশে। এই রিয়েলিটির নাম সাবজেক্টিভ রিয়েলিটি। এতোদিন সে অবজেক্টিভ রিয়েলিটির কারাগারে বন্দী ছিল। ভাষা তাকে হঠাৎ মুক্তির স্বাদ এনে দিল।
আমরা সাধারণ মানুষ যখন একটা গাছ, পাথর কিংবা লতাপাতা দেখি, সেটা আমাদের কাছে গাছ, পাথর কিংবা লতা-পাতাই। কিন্তু বিভূতিভূষণ যখন ঠিক সেই একই গাছপাতা দেখেন, তখন সেটা হয়ে যায় স্বপ্ন ও বাস্তবতার মাঝামাঝি এক অসাধারণ গল্প।
আমরা একটা বেকার, ভবঘুরে ছেলেকে প্রতিদিনই দেখি চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে, একা একা রাস্তায় হেঁটে বেড়াতে। সেই ছেলেটিকেই যখন হুমায়ূন আহমেদ দেখেন, সেটা হয়ে যায় সমাজ বাস্তবতার এক রুদ্ধশ্বাস গল্প। গল্পকাররা এভাবেই চিরকাল অবজেকটিভ রিয়েলিটি-কে সাবজেক্টিভ রিয়েলিটিতে- নিয়ে যাবার কাজটি চমৎকারভাবে করে যাচ্ছেন।
কথা হচ্ছে, গল্প বলে লাভটা কী? আধুনিক গল্পকাররা না হয় গল্প লিখে দুটো টাকাপয়সা পান। ঈশপ বা হোমাররা তাও পেতেন না। তাদের সম্বল ছিল গল্প বলে পাওয়া খ্যাতিটুকু। শ্রোতা কিংবা পাঠকরাও না হয় গল্প শুনে ক্ষণিকের আনন্দ পায়। কিন্তু গল্পের ভূমিকা কি এই ক্ষণিকের আনন্দ দানেই শেষ?
উহুঁ। আমাদের আজকের অস্তিত্বের পেছনেই এই গল্পের একটা বড়সড় ভূমিকা আছে।
আমরা যখন গল্প বলি, সেটা আমাদের অজান্তে আমাদের মধ্যে একটা মিথের জন্ম দেয়। এই মিথই আমাদের মধ্যে সামাজিক বন্ধন বাড়ায়। আপনি যদি ছোটবেলায় আপনার দাদী কিংবা নানীর কাছে থেকে ভূতের গল্প শুনে থাকেন, আপনি ব্যাপারটা রিলেট করতে পারবেন। দাদী বা নানীর কিছুই হয়তো আপনার মনে নেই, কিন্তু তার মুখে শোনা ঐ গল্পগুলো মনে আছে। আপনার নানু কোন ব্র্যান্ডের পান কঝেতো, আপনার মনে নেই। কিন্তু যখনই ঐ গল্প বলা সন্ধ্যের কথা মনে পড়ে, অজান্তে আপনার গলা ভারী হয়ে আসে। আপনি যখন একজন মুক্তিযোদ্ধার কাছে অপারেশনের কাহিনী শুনবেন, অজান্তেই আপনার রোমকূপগুলো দাঁড়িয়ে যাবে। মনে হবে, এখনই যুদ্ধে চলে যাই।
গল্পের নানী কিংবা মুক্তিযোদ্ধার ঐ গল্প কেবল যে মিথের জন্ম দিচ্ছে, তা না। জন্ম দিচ্ছে সমাজ ও প্রতিষ্ঠানের। নানীর মুখে বলা গল্প আপনাকে আপনার মায়ের সাথে আরো ঘনিষ্ঠ করছে। আপনারা দু’জন গল্প করার একটা কমন প্লাটফর্ম খুঁজে পাচ্ছেন। মুক্তিযোদ্ধার ঐ গল্প আপনাকে বাংলাদেশী হিসেবে গর্বিত করছে। শত সমস্যার মধ্যেও এই দেশটা যে আপনার, আবারো কোনদিন বর্গী এলে আপনাকেই যে অস্ত্র হাতে দাঁড়াতে হবে—এই বোধে উদ্দীপ্ত করছে। গল্প বা মিথ অচেনা দু’জন মানুষকে এক প্লাটফর্মে এনে দাঁড় করায়। এই প্লাটফর্মকেই আমরা দেশ, কাল, জাতীয়তাবোধ—নানা নামে আখ্যায়িত করি।
ধর্ম বলেন, সমাজ বলেন, প্রতিষ্ঠান বলেন—অবজেক্টিভ প্থিবীতে এদের কোন অস্তিত্ব নেই। এদের অস্তিত্ব পুরোটাই আমাদের মনে। আমরা গল্প আর মিথ মিলিয়ে আমাদের চারপাশে একটা সাবজেক্টিভ রিয়েলিটি তৈরি করেছি। সেই রিয়েলিটি-তে যখন আমাদের মত আরো হাজার কিংবা লাখখানেক মানুষ বিশ্বাস স্থাপন করেছে, তখন সেটা পরিণত হয়েছে ইমাজিনড রিয়েলিটি-তে।
শুনে হাসতে পারেন, বাংলাদেশ বলে কোন দেশ কিন্তু আসলে নেই। দেশ আছে আমাদের ষোল কোটি মানুষের ইমাজিনড রিয়েলিটি-তে। একইভাবে, ব্র্যাক বলে কোন প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব কিন্তু বাস্তবে নেই। এটা পুরোপুরিই ফজলে হাসান আবেদের তৈরি একটা মিথ। ভদ্রলোক মিথ তৈরি করেই থেমে থাকেননি। সেই মিথকে নিজ কর্মের মাধ্যমে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন দিনে দিনে। তার তৈরি করা সাবজেক্টিভ রিয়েলিটি এক সময় অংশ হয়ে গেছে আমাদের দৈনন্দিনতার। আমরা নিজের অজান্তে হয়ে গেছি একটি ব্হৎ ইমাজিনড রিয়েলিটির অংশ। আর মানুষের স্বভাবই হচ্ছে এই যে—সে নিজেকে ইমাজিনড রিয়েলিটির অংশ ভাবতে ভালোবাসে। কেউ তাই মুসলিম পরিচয়ে গর্ববোধ করে, কেউ বাংলাদেশী পরিচয়ে আর কেউ কানাডা-অস্ট্রেলিয়ায় পিআর পেলে।
আপনার বর্তমানেও এই গল্পগুলো একটা ভূমিকা রেখে চলে। আপনি হয়তো ব্র্যাক বা বাংলালিঙ্কে জব করেন। আপনার টিম লীডার সপ্তাহের শুরুতে আপনাদের একটা গল্প বলেন। এইভাবে এইভাবে কাজ করলে আমরা প্রজেক্টটা পাব কিংবা প্রবলেমটা সল্ভ করতে পারবো। টিম লীডারের কাজ আপনাদের চারপাশে একটা মিথ তৈরি করা। প্রজেক্টটা পেলে বা প্রবলেমটা সমাধান হলে সমাধান হলে আমরা সবাই হয়তো একদিন ব্যাটন রুজে খেতে যাবো। কিংবা আমাদের কারো কারো প্রমোশন হবে। আমরা একটা ফ্ল্যাট বুকিং দিতে পারবো। কিংবা গাড়ির জন্য লোন নিতে পারবো। এই ব্যাপারগুলো ইমপ্লিসিট থাকে। কিন্তু টিম লীডার লোকটা যদি একজন ভালো গল্প বলিয়ে হন, তিনি আপনার মধ্যে এই স্বপ্নগুলো ঢুকিয়ে দিতে পারবেন। আপনি আর আপনার কলিগেরা মিলে তখন জীবন যৌবন ভুলে প্রজেক্টের জন্য কাজ করবেন। আর এইভাবেই একটা ভালো গল্প বা মিথ আমাদের মধ্যে স্বার্থের হলেও একটা বন্ধন তৈরি করে দিবে।