এদিক থেকে প্রথম আধুনিক মানুষ ছিলেন আমেরিগো ভেসপুচি। কলম্বাসের কয়েক বছর পর ইতালির এই ভদ্রলোক আমেরিকায় সমুদ্রাত্রা করনে। সময়টা ছিল ১৪৯৯-১৫০৪। এই সময়ের মধ্যে তিনি দুটো বইও লিখে ফেলেন। এখানেই তিনি প্রথম দাবি করেন, কলম্বাস যেখানে আসছিলেন, ওটা আসলে এশিয়ার পূর্ব উপকূলের কোন দ্বীপ না। ওটা নতুন একটা মহাদেশের অংশ। যে মহাদেশ সম্পর্কে আমরা এখনো জানি না।
তার কথাবার্তায় কনভিন্সড হয়ে মার্টিন ওয়ালসেমুলার নামে সেকালের এক বিখ্যাত মানচিত্র নির্মাতা এই নতুন মহাদেশকে মানচিত্রে ঢুকিয়ে দেন। এখন এই নতুন মহাদেশের তো একটা নাম দিতে হবে। ওয়ালসেমুলারের ধারণা ছিল, আমেরিগো-ই এই নয়া মহাদেশের আবিষ্কারক। আমেরিগোর নাম অনুসারে তিনি এর নাম দেন আমেরিকা। তার এই ম্যাপখানা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। আর প্থিবীর বুকে আমেরিকা নামখানি-ই খোদাই হয়ে যায়।
কলম্বাসের নামে আমেরিকায় বেশ কিছু শহরের নাম আছে। দক্ষিণ আমেরিকায় একটা দেশের নামও আছে। কিন্তু ঐ গোঁয়ার্তুমিটা না করলে হয়তো আজ প্থিবীর দু দুটো মহাদেশের নাম আমেরিকা না হয় কলম্বিয়া হত। ইতিহাসের অল্প কয়টা ‘পোয়েটিক জাস্টিস’ এর মধ্যে এটা একটা। কলম্বাস তার অজ্ঞানতাকে স্বীকার করতে চাননি। আর আমেরিগো ভেসপুচির এই স্বীকারটুকু করার সাহস ছিল বলে নতুন পৃথিবীর নাম তার নামেই হল।
সায়েন্টিফিক রেভোল্যুশন এগজ্যাক্টলি কবে শুরু হয়, তার যদি কোন ল্যান্ডমার্ক চিহিত করতে হয়, তবে ইউরোপীয়ানদের এই আমেরিকা আবিষ্কার-ই সেই ল্যান্ডমার্ক। এর মধ্য দিয়ে মানচিত্র নির্মাতারাই কেবল মানচিত্রের ফাঁকা জায়গাগুলো ভরাট করা শুরু করলেন না, তাদের সাথে এগিয়ে এলেন জ্ঞানের সব শাখার লোকেরা। উদ্ভিদ ও প্রাণিবিদ, পদার্থ ও রসায়নবিদ, তাত্ত্বিক ও ধার্মিক—সবাই। সবাই পাগলের মত যার যার ফিল্ডের ফাঁকা জায়গাগুলো ভরাট করা শুরু করলেন।
ইউরোপীয় ছাড়া আর এক দলের সামান্য সম্ভাবনা ছিল নতুন প্থিবীর মালিক হবার। তারা হল চাইনিজ। কলম্বাসের যাত্রার বেশ আগে ১৪৩৩ সালে মিং রাজারা এক বিরাট লটবহর পাঠান ভারত মহাদেশ এক্সপ্লোর করতে। ৩০০ জাহাজ ওয়ালা সেই বহর শ্রীলংকা, ভারত, পারস্য উপসাগর ঘুরে আফ্রিকার পূর্বভাগে ছুঁয়ে যায়।
কলম্বাসের সাথে এই অভিযানের পার্থক্য ছিল—এরা একদম নতুন, অপরিচিত কোন ভূমির সন্ধান পায়নি। যে দেশগুলো ছুঁয়ে গেছে, তাদেরকেও কলোনাইজ করার চেষ্টা করেনি। আর সবচেয়ে বড় কথা, এই দুঃসাহসী অভিযান ব্যাপারগুলো কেন যেন চাইনিজ কালচারের সাথে খুব যায় না। তাদের ট্রাডিশনাল কালচারে গতির চেয়ে স্থিতিকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ্যাদ্ভেঞ্চার নয়, স্ট্যাবিলিটি তাদের মূল মোক্ষ। বেইজিং এ তাই ক্ষমতার পালাবদলের পর এইসব অভিযানে ফান্ডিং-ও গুটিয়ে আনা হয়। চাইনিজদের নতুন প্থিবী জয়ের স্বপ্নও সেইখানেই থমকে যায়।
ইউরোপীয়ানদের এই পাগলামির আমরা অনেক সময় ক্রেডিট দিতে চাই না। ইউরোপীয় কলোনিয়ালিজমের আমরা সমালোচনা করতেই পারি, সেই সাথে ওদের সাহসের প্রশংসাও করতে হবে। সেকালের প[রস্পেক্টিভে এটা কিন্তু ছিল চূড়ান্ত মাত্রার দুঃসাহসিক যাত্রা। আজ আমাদের জন্য অন্য কোন গ্রহে বসতি স্থাপন করা যতোটা কঠিন, ইউরোপীয়দের অভিযানগুলোও ঠিক ততোটাই কঠিন আর অনিশ্চিত ছিল।
সেসময় যে মানুষ অন্য দেশ দখল করতে যাত্রা করতো না, তা না। কিন্তু সেটা ছিল নিজেদের আশেপাশের চল্লিশ দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। খুব দূরে কোথাও যাত্রা করে সাম্রাজ্য স্থাপনের কথা এট লিস্ট কেউ ভাবতো না। তাও অজানা আর দীর্ঘ সমুদ্রপথে। আলেকজান্ডার বহুদূর থেকে এসে ভারবর্ষে আক্রমণ করসেন। কিন্তু এখানে সাম্রাজ্য স্থাপন করেননি। বা থেকে যাননি। থেকে গেছে মোগলরা। যারা এক অর্থে আমাদের প্রতিবেশীই ছিল।
আর একটা উদাহরণ দিই। রোমানরা এত্রুরিয়া জয় করসে ৩০০-৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। এত্রুরিয়া রক্ষা করার জন্য তারা জয় করসে পো ভ্যালী (২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে)। পো ভ্যালী সিকিউরিটি নিশ্চিত করার জন্য জয় করসে জয় করসে প্রোভেন্স (১২০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে), প্রোভেস্নকে রক্ষা করার জন্য গল (আ জকের ফ্রান্স, ৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) আর গলকে রক্ষা করার জনন্য ব্রিটেনের দখল বুজে নিসে ৫০ খ্রিস্টাব্দে। লন্ডন থেকে রোমে যাইতে তাদের ৪০০ বছর লেগে গেছে। ৩৫০ খ্রিস্টাব্দে রোমানরা ভুলেও লন্ডন জয়ের স্বপ্ন দেখতো না। ইউরোপীয়রা সেটাই দেখসে। আগের সমস্ত ধ্যান-ধারণা ভেঙে সম্পূর্ণ অজানার ইদ্দেশ্যে যাত্রা করসে। আর সফলও হইসে।
আজ যে আমরা সবাই এক প্থিবীর বাসিন্দা, এক ধরণী মাতার সন্তান—এই বোধটা কিন্তু ইউরোপীয়দের এই অভিযানগুলোই আমাদের মধ্যে তৈরি করসে। এর মাশুলও আমাদের দিতে হয়েছে। একটা নয়, দুটো নয়, চার চারটে মহাদেশ ইউরোপীয়দের নামে লিখে দিয়ে।
শেষটা করি মন্টেজুমার গল্প দিয়ে।
মন্টেজুমা ছিলেন আজটেকদের সম্রাট। আজটেকদের শেষ সম্রাট।
শেষ সম্রাট বলেই এই গল্পে আরো একটা চরিত্র চলে আসবে। ইনি গল্পের ভিলেন। শক্তিশালী এই ভিলেনের নাম কর্টেজ।
গল্পের পটভূমি ১৫০০ সাল, আজকের আমেরিকা। আজটেকরা তখন এই আমেরিকায় সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যটির মালিক।