আর এটাই ইউরোপীয়ান সাম্রাজ্যবাদের সাথে অন্য সাম্রাজ্যগুলোর একটা বড় পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। আগেকার সাম্রাজ্যগুলো কেবল মাটির দখল নিত। মানচিত্রে নিজেদেরে কলার উঁচিয়ে হাজির করতো। ইউরোপীয় সাম্রাজ্যই প্রথম সাম্রাজ্য, যে মাটির দখলের সাথে সাথে ঐ এলাকার জ্ঞানরাজ্যের দখলও বুঝে নেয়।
যে কোন ইউরোপীয় অভিযানে তাই আর্মির সাথে সাথে একদল ডাক্তার থাকতো। থাকো বোটানিস্ট, জুওলজিস্ট, এ্যাস্ট্রোনোমার, জিওলজিস্ট। এদের কাজ ছিল আধিক্ত অঞ্চলের সব কিছু, লিটার্যালী সব কিছু নিয়ে গবেষণা করা। জ্ঞানরাজ্যে নিজেদের হেজিমনি প্রতিষ্ঠা করা। ইউরোপীয়রা, এটা বুঝেছিল, মাটির রাজ্য আসলে রাজ্য না। জাস্ট দিখাওয়া। আসল রাজ্য হচ্ছে জ্ঞানরাজ্য। এইখানে একবার নিজেদের হেজিমি প্রতিষ্ঠা করতে পারলে মাটির রাজ্য এমনিই তাদের হাতে থাকবে।
ক্যাপ্টেন কুক যেটা করেছিলেন। সে সময় জাহাজ যাত্রায় স্কার্ভির খুব প্রাদুর্ভাব দেখা দিত। প্রতি যাত্রাতেই অর্ধেকের বেশি লোক এই রোগে ভুগে মারা পড়তো। এক ডাক্তার এক্সপেরিমেন্ট করে দেখলেন, যেসব লোককে সাইট্রাস ফল খেতে দেয়া হচ্ছে, তারা খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে ঠছে। আজ আমরা জানি, সাইট্রাস ফলে ভিটামিন সি আছে যা স্কার্ভি প্রতিরোধ করে। সেসময় তো মানুষ এতো কিছু জানতো না। তারা মেইনলি শুকনা খাবার দাবার, বিস্কিট-টিস্কিট—এসব নিয়েই সমুদ্র যাত্রায় বেরিয়ে পড়তো।
ডাক্তারের এই এক্সপেরিমেন্টকে তেমন একটা কেউ পাত্তা দিল না। একজন মাত্র দিলেন। তিনি ক্যাপ্টেন জেমস কুক। তিনি বুঝলেন, নাবিকেরা ঠিকমত পুষ্টি উপাদান পাচ্ছে না। তাই তাদের এই দুর্দশা। তিনি জাহাজ বোঝাই ফলমূল আর সবজি নিয়ে রওনা দিলেন এইবার। ফলাফল হাতেনাতে পেলেন। একটা লোকও স্কার্ভিতে মারা পড়লো না এবার।
বিজ্ঞানের এই আশীর্বাদে অতি দ্রুত ইংরেজরা গোটা সমুদ্রপথে রাজত্ব কায়েম করলো। অর্ধেক প্থিবীর রাজা হবার জন্য যতোটুকু ধন্যবাদ ইংরেজ আর্মি আর তার টেকনোলজি পাবে, ঠিক ততোটুকু ধন্যবাদই প্রাপ্য সেই অখ্যাত ডাক্তার আর ক্যাপ্টেন কুকের।
এখানেই শেষ নয়। নেপোলিয়ন যখন মিশর আক্রমণ করেন, তখন উনি সাথে করে ১৬৫ জন স্কলার নিয়ে যান। এদের কাজ ছিল মিশরের ইতিহাস, ধর্ম, কালচার—সব কিছু নিয়ে গবেষণা করা। এদের হাত ধরেই জ্ঞানের একটা নতুন শাখার জন্ম হয়। যার নাম Egyptology.
১৮৩১ সালে ব্রিটিশ নেভী গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে যাত্রা করে। দ্বীপগুলো ছিল যুদ্ধকালীন সময়ের জন্য স্ট্রাটেজিক্যালী ইম্পর্ট্যান্ট। জাহাজের ক্যাপটেন নিজেও ছিলেন একজন শখের বিজ্ঞানি। উনি দলে একজন ভূতাত্ত্বিককে নেবার সিদ্ধান্ত নেন। জিওলজির প্রফেসররা একের পর এক তাকে ‘টাইম নাই’ জানিয়ে দেন। শেষমেশ বিরক্ত হয়ে তিনি সদ্য ক্যামব্রিজ পাশ করা এক ছাত্রকে এই জবের অফার দেন। ছাত্রটিও খুশিমনে এই অফার লুফেও নেয়। ক্যাপ্টেন ওখানে গিয়ে মিলিটারী ম্যাপ তৈরি করেন। আর ক্যাম্ব্রিজের স্টুডেন্টটি নিয়ে আসে রাশি রাশি ডাটা। যা কিনা একদিন আমাদের মনোজগতে বিরাট আঘাত হানবে।
তরুণ সেই গ্র্যাজুয়েটের নাম চার্লস ডারউইন। আর তার প্থিবী কাঁপানো তত্ত্বের নাম ‘থিওরি অফ ইভোল্যুশন’।
মানচিত্র আঁকার অভ্যাস আমাদের অনেক আগে থেকেই ছিল। সমস্যা হল, ঐ মানচিত্রগুলো ছিল অসম্পূর্ণ। আমরা, আফ্রো-এশিয়ার লোকজন তখন আমেরিকা সম্পর্কে জানতাম না। আমেরিকার আদি অধিবাসীরাও আমাদের সম্পর্কে জানতো না। কাজেই, আফ্রো-এশিয়ার মানচিত্র এঁকেই আমরা একে গোটা প্থিবীর মানচিত্র বলে চালিয়ে দিতাম।
আমাদের এই আইডিলোজিতে প্রথম আঘাতটা হানে ইউরোপীয়রা। তারা মানচিত্রের স্থানে স্থানে ফাঁকা রেখে একে আঁকতে শুরু করে। ইউরোপীয়ানদের চিন্তাধারায় যে বড়সড় পরিবর্তন আসছে, এটা তার প্রথম লক্ষণ। এশিয়ানরা যেখানে ‘সব জেনে বসে আছি ভাব’ নিয়ে লিটার্যালী বসে ছিল, সেখানে নিজেদের অজ্ঞানতাকে ওরা খোলা বাজারে স্বীকার করা শুরু করে। আর সেই অজানা ভূমির খোঁজে পাল তুলে বেরিয়ে পড়ে।
কলম্বাস নিজেও অবশ্য প্থিবীর পূর্ণাঙ্গ মানচিত্রে ঈমানধারীদের একজন ছিলেন। উনি হিসেব কষে দেখেছিলেন, স্পেন থেকে সোজা পশ্চিমে যাত্রা করলে ৭ হাজার কিলোমিটার পর তিনি জাপান পৌঁছে যাবেন। তার এই হিসাব ঠিক মিললো না। ৭ হাজার নয়, ২০ হাজার কিলোমিটার যাত্রার পর তার জাহাজের এক নাবিক অদূরে স্থলভাগের চিহ্ন দেখে “মাটি, মাটি” বলে চেঁচিয়ে ওঠে। এই স্থলভাগকেই আজ আমরা বাহামা বলে জানি।
স্পেন আর জাপানের মাঝখানে আর কিছু যে থাকতে পারে—কলম্বাস এতে বিশ্বাস করতেন না। তার বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল, তিনি এশিয়ার পূর্ব প্রান্তের কোন দ্বীপে এসে পৌঁছেছেন। তিনি এই নতুন মানুষদের নাম দিলেন ইন্ডিয়ান। তিনি যে একটা সম্পূর্ণ নতুন মহাদেশ আবিষ্কার করে ফেলেছেন—এই ব্যাপারটা তিনি নিতেই পারলেন না। কাজেকর্মে আধুনিক আর সাহসী হলেও মনে আর মননে কলম্বাস ছিলে পুরোপুরি মধ্যযুগের মানুষ। বাইবেলের উপর তার ছিল গভীর আস্থা। একটা বিরাট মহাদেশ থাকবে আর তার কথা বাইবেলে থাকবে না—এমনটা হতে পারে না। এই বিরাট ভুল নিয়েই তিনি সারা জীবন কাটিয়ে দেন।