তারপরও মানুষের মধ্যে এই ভয় যায় নাই যে, আমরা আমদের সব এনার্জি শেষ করে ফেলতেসি। জীবাশ্ম জ্বালানির ভাণ্ডার খতম হয়ে যাচ্ছে। অথচ জীবাশ্ম জ্বালানি কিন্তু আমাদের এনার্জির খুব গুরুত্বপূর্ণ সোর্স না। সবচেয়ে বেশি এনার্জি স্টোর হয়ে আছে সূর্যে। সূর্য থেকে প্রতি বছর ৩,৭৬৬,৮০০ এক্সাজুল পরিমাণ শক্তি পৌঁছায় আমদের প্থিবীতে। দুনিয়ার সব মানুষ আর ইন্ডাস্ট্রি মিলে বছরে আমাদের লাগে মাত্র ৫০০ এক্সাজুল। এক্সাজুল যে কতো বড় ইউনিট তা বোঝানোর জন্য বলি—১ এর পর ১৮টা শূন্য বসান। তাইলে ১ এক্সা হয়।
বোঝাই যাইতেসে, সূর্যদেব আমাদের দুহাত ভরে যা দেন, তার কিছুই আমরা ঠিকমত নিতে পারতেসি না। নিতে পারলে উনি দেড় ঘণ্টায় আমাদের যা পাঠান, তা দিয়েই আমাদের বাৎসরিক এনার্জির দুশ্চিন্তা শেষ হয়ে যেত। লোডশেডিং-এর জন্যও সরকারকে আর গালি দেয়া লাগতো না।
এতো মাত্র একটা সোর্সের কথা বললাম। চোখ মেলে তাকালে বোঝা যাবে—আমাদের চারপাশে এনার্জির ছড়াছড়ি। পরমাণুর মধ্যে শক্তি। গ্র্যাভিটির মধ্যে শক্তি। শক্তি নাই কোথায়? শুধু দরকার এই শক্তিগুলাকে ক্যাপচার করার নতুন নতুন তরিকা।
১৭৫০ সালেও ইউরোপ আর এশিয়া একই কাতারে ছিল। ১৭৫০-১৮৫০, এই একশো বছরে পাওয়ারটা পুরোপুরি ইউরোপে শিফট করে।
প্থিবীতে কার রাজ চলছে, তা বোঝার একটা প্যারামিটার হতে পারে মোট উৎপাদন যন্ত্রে কার কন্ট্রিনিউশন কেমন। যার উৎপাদন যতো বেশি, ক্ষমতার ভারকেন্দ্রও তার দিকেই ততো হেলে থাকবে। ১৭৭৫ সালেও প্থিবীর মোট উৎপাদনের ৮০ ভাগ হত এশিয়ায়। দুই শতাব্দীর মধ্যে পাশার দান ঘুরে যায়। ১৯৫০ সালে এসে দেখা যায়, প্থিবীর মোট উৎপাদনের অর্ধেকের বেশি করছে ইউরোপ আর তাদের কাজিন নব্য আমেরিকানরা মিলে।
যে ইউরোপকে কেউ এককালে পাত্তাই দিত না, তাদের মধ্যে হঠাৎ কী এমন হল যে তারা নতুন নতুন দেশ-মহাদেশ জয় করা শুরু করলো? নিজেদের বিজয় নিশান দিকে দিকে ওড়াতে লাগলো? চাইনিজ বা অটোম্যানরা কেন এই কাজটা করতে পারলো না? ইউরোপীয়দের চেয়ে তাদের ইতিহাস তো বরং সম্দ্ধ ছিল। ছিল স্ট্রং শাসন ব্যবস্থা।
ইউরোপীয়রা না হয় স্টীম ইঞ্জিন আবিষ্কার করলো। অটোম্যানরা তো সেটা কিনে নিজেদের দেশে চালু করতে পারতো। কিংবা চাইনিজরা কপি করে নিজেদের ভূখণ্ডে ছাড়তে পারতো। সেকালে তো পেটেন্ট নিয়েও এতো কড়াকড়ি ছিল না। প্রাচ্যের লোকজন এর কোনটাই করলো না।
প্রাচ্যের লোকজনের যে টাকাকড়ির অভাব ছিল—তা না। ছিল মাইন্ডসেটের অভাব। উদারতার অভাব। ফলে ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার লোকটা যা আবিষ্কার করসে, ফ্রান্সের লোকজন, জার্মানির লোকজন সেটা খুব দ্রুতই আপন করে নিতে পারসে। কিন্তু ইস্তানবুল বা সাংহাইর লোকজন পারে নাই।
পশ্চিমকে আমরা রাজত্ব করতে দেখসি ১৭৫০ থেকে। আমরা আসলে দেখসি ফলাফলটা। ‘কারণ’-টা কিন্তু আরো আগে থেকেই শুরু হইসে। এই সময়কালটা হল ১৫০০ থেকে ১৭৫০ পর্যন্ত।
১৭৫০ এর যে আপাত সাম্য আমরা দেখছি এশিয়া আর ইউরোপের মধ্যে, সেটা আসলে একটা ধোঁকা। ধোঁকাটা কীরকম বলি।
ধরা যাক, দুইজন ইঞ্জিনিয়ার। প্রত্যেকেই উঁচু লম্বা একটা বিল্ডিং বানাবে। একজন ইট ব্যবহার করতেসে। আরেকজন স্টীল আর কংক্রীট। শুরু কয়কে তলা দুজন ঠিকঠাকই বানাবে। এ্যাপারেন্ট কোন পার্থক্য চোখে পড়বে না। একটা থ্রেশোল্ড ক্রস করে ফেললে (ধরা যাক আট তলা), ইটের বাড়িটা আর লোড নিতে পারবে না। হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। স্টীলের দালানটা ওদিকে আকাশ ছুঁচ্ছে।
ইউরোপের দালানটা হচ্ছে স্টীলের দালান। আর প্রাচ্যের বাড়িঘর ছিল ইট-কাঠ-সুড়কির। নতুন যুগের লোড সে নিতে পারে নাই।
ইউরোপ কীভাবে এই ভারটা নিতে পারলো? কারণ তার ভিত্তিটা সে মজবুত করে নিসে আগের আড়াইশো বছরে। বিজ্ঞান আর পুঁজিবাদ হলো ইউরোপের সেই স্টীল আর কংক্রীট।
ইউরোপীয়রাই সবার আগে সায়েন্টিফিক ওয়েতে চিন্তাভাবনা শুরু করে। সায়েন্টিফিক আর পুঁজিবাদী ধারায়। পুঁজির মালিকেরা এখন আর তাদের রবরবা ধরে রাখার জন্য খালি আর্মি পালতে শুরু করলো না, সেই সাথে বিজ্ঞানীদের খোরাকিও দিতে লাগলো। বিজ্ঞানীরাও আগের মত আর বিজ্ঞানের জন্য বিজ্ঞান করতে লাগলেন না। তারা রাষ্ট্রের প্রয়োজনে, পুঁজিবাদীদের প্রয়োজনে বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিলেন।
বিজ্ঞান আর সাম্রাজ্যবাদের এই যে মিলন—এটাই ইউরোপীয়দের অন্যদের চেয়ে দুশো বছর এগিয়ে দিল।
আমাদের অনেকেরই বিজ্ঞান পছন্দ, বিজ্ঞানের ফল পছন্দ, কিন্তু পুঁজিবাদ পছন্দ না। অথচ পুঁজিবাদের সাথে বিজ্ঞানের এই বোঝাপড়া না হলে কিন্তু বিজ্ঞান এতো দ্রুত আর এতোদূর আগাতো না। গানপাউডারের যুগেই বসে থাকতে হত আমাদের।
ইউরোপীয়দের জিনে এমন কিছু আছে, যা তাদেরকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই এই রেসে এগিয়ে দিয়েছে—এমন ধারণা তাই আর হালে পানি পায় না। ইউরোপীয়রা জ্ঞান-বিজ্ঞানের উসাইন বোল্ট না। চায়না বা ইসলামের ইতিহাস ঘাঁটলেও নিউটনের মত স্কলার পাওয়া যাবে। নিউটনের মত প্রলিফিক হয়তো না, কিন্তু তার সমান মেধাসম্পন্ন লোক ঠিকই পাওয়া যাবে। নিউটন তবে নিউটন হলেন কেন? নিউটনের জন্ম ইংল্যান্ডে না হয়ে কায়রো বা বেইজিং এ হল না কেন?
কারণ, নিউটন হবার জন্য যে এনভাইরনমেন্ট দরকার, নিউটন সেটা পুরোপুরিই পেয়েছিলেন। ক্যামব্রিজ তাকে সেভাবে কিছু না শেখালেও পরিবেশটা ঠিকই দিয়েছে। একটা বাচ্চা যতো মেধা নিয়েই জন্মাক না কেনো, উগান্ডা বা উজবেকিস্তানে কোন নিউটনের জন্ম হবে না। রূঢ় হলেও এটাই সত্য। বিজ্ঞান তো কতগুলো ভাবনার সমষ্টি না। ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেবার জন্য আপনার যে ইকুইপমেন্ট লাগবে, ফান্ডিং লাগবে–ওটা দিবে কে? আফ্রিকা থেকে সাহিত্যে নোবেল আসে, বিজ্ঞানে আসে না কেন?