প্রথম ইঙ্গিতটা আসে গানপাউডার দিয়ে। নবম শতাব্দীর মাঝামাঝি চায়নার এর আবির্ভাব। সেই সময় গানপাউডার ব্যবহার হত আগুনের গোলা বানাতে। কিন্তু সেই গোলার পিছনে যে ঠিকঠাক তাপ দিলে সেই গোলাই বহুদূর যাবে, এই ভাবনা তখনো মাথায় আসে নাই। যখন মাথায় আসছে, ততোদিনে আরো ৬০০ বছর পেরিয়ে গেছে। বন্দুকের মূলনীতি আবিষ্কারের অনেক কাছাকাছি এসেও তাই চাইনিজরা এই এ্যাচিভমেন্ট আনলক করতে পারে নাই। আনলক করসে ইউরোপীয়ানরা।
তাও আরো তিনশো বছর পর। তাপশক্তি যে গতিশক্তিতে রূপান্তর হয়—এইটা তারা বুঝছে স্টীম ইঞ্জিন আবিষ্কার করে। যদিও স্টীম ইঞ্জিনের আঁতুরঘর কোন রেলওয়ে শপ বা মেশিন শপে নয়। এর জন্ম নোংরা, ছোটলোক কয়লা খনিতে।
ব্রিটেনে তখন জনসংখ্যা বাড়ছে। আর বেশি জনসংখ্যা মানে এনার্জি কনসামশনও বেশি। নতুন মানুষ মানে নতুন নতুন বাড়িঘর তৈরি করতে হবে তাদের জন্য। সেকালে সব কাঠের বাড়িঘর তৈরি হত। রিয়েল এস্টেটের চাহিদা মেটাতে বনকে বন বন উজাড় করা হল। ফলে জ্বালানি কাঠের অভাব দেখা দিল। সেই অভাব পূরণ করতে এগিয়ে এল কয়লা। কয়লা পুড়িয়ে রান্নার চল হল।
সমস্যা হল কয়লা উত্তোলনে। অনেক কয়লাখনিতে একটু নিচের দিকের স্তরে পানি জমে থাকে। ঐ স্তর থেকে আর কয়লা কালেক্ট করা যায় না। তো এই সমস্যার সমাধান কী?
সমাধান নিয়ে এল স্টীম ইঞ্জিন।
কয়লা পুড়ায়া যে তাপটা তৈরি হয়, সেই তাপ দিয়ে পানি গরম করা হয়। পানি ফুটে বাষ্প হয়। সেই বাষ্প একটা পিস্টনকে ধাক্কা দেয়। পিস্টন লড়ে। এখন পিস্টন নড়লে পিস্টনের সাথে যাকেই বেঁধে দেয়া হবে, সেও নড়বে। ব্যাং! ঘরে বসেই আপনি তৈরি করে ফেললেন একখানা আস্ত স্টীম ইঞ্জিন।
কয়লা খনিগুলোতে এই পিস্টনটা একটা পাম্পের সাথে লাগানো থাকতো। এই পাম্প খনির গভীরের পানি বাইরে বের করে দিত। শুরুর দিকের পাম্পগুলো ছিল খুবই ইনএফিশিয়েন্ট। বস্তা বস্তা কয়লা পুড়াইলে হয়তো সামান্য পরিমাণ পানি বের হইতো। যেহেতু কয়লাখনির পাশে কয়লার কোন অভাব ছিল না—এটা কোন বড় ইস্যু হয়ে দেখা দিল না।
আস্তে আস্তে ইঞ্জিনের এফিশিয়েন্সি বাড়লো। কয়লা খনি থেকে তুলে একে স্থান দেয়া হল টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিতে। চোখের পলকে গোটা টেক্সটাইল শিল্পে একটা বিপ্লব ঘটে গেলো। কাপড়ের দাম হু হু করে পড়ে গেলো।
সেই সাথে পড়ে গেলো আমাদের উপমহাদেশের তাঁত শিল্প। মিথ আছে, ব্রিটিশরা নাকি আমাদের সেরা তাঁত শিল্পীদের আঙুল কেটে দিত। যাতে তারা মসলিন আর যতো মিহি কাপড় বুনতে না পারে। এটা যতোটা না ঐতিহাসিক সত্য, তার চেয়ে অনেক বেশি সিম্বলিক সত্য। টেক্সটাইলের আগ্রাসনের সাথে আমাদের কুটির শিল্প তাল মেলাতে পারছিল না। বাজার অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মেই আমরা হেরে যাচ্ছিলাম। হেরে যাচ্ছিলো আমাদের তাঁত শিল্পীরা। এই হেরে যাওয়াটা লিটার্যালী আঙুল কাটার চেয়ে কোন অংশে কম কষ্টের না।
স্টীম ইঞ্জিন মাটির নিচ থেকে উপরে উঠে আসায় টেকনোলজিক্যাল ব্যারিয়ারের সাথে সাথে একটা সাইকোলজিক্যাল ব্যারিয়ারও আমরা কাটিয়ে উঠলাম। কয়লা পুড়ায়া যদি তাঁত চালানো যায়, তবে অন্য জিনিস নয় কেনো? ধরেন, গাড়িঘোড়া।
১৮২৫ সালে এক চতুর ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার স্টীম ইঞ্জিনের সাথে ট্রেনের কতগুলা বগি জুড়ে দিলেন। কাকতালীয়ভাবে, সেই বগিগুলোও কয়লাই নিয়ে যাচ্ছিল। তখন মানুষের মাথায়া আসলো— আরে, স্টীম দিয়ে যদি কয়লা আনা-নেয়া করা যায়, তবে মানুষ নয় কেন? আমরা মানুষেরা তো আর বানের জলে ভেসে আসি নাই।
আমাদেরও আছে অধিকার। স্টীম ইঞ্জিন চালিত যানে চলার।
১৮৩০ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর আসলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। দুনিয়ার প্রথম কমার্শিয়াল রেলওয়ে সেদিন চালু হইলো। লিভারপুল থেকে ম্যানচেস্টার। কয়েক বছরের মধ্যে রেলওয়ে ট্র্যাক গোটা ব্রিটেনকে ছেয়ে ফেললো।
যদি ভেবে থাকেন, ব্রিটিশরা তাদের চাতুর্য দিয়েই অর্ধেক দুনিয়া জয় করেছিল, তাহলে ভুল করবেন। ব্রিটিশরা সেকালে ছিল টেকনোলজিক্যালী সবচেয়ে এগিয়ে। শিল্প বিপ্লব বলতে গেলে এই জাতির হাত ধরেই হয়েছে। আর প্থিবীর ইতিহাস আমাদের বলে, যে জাতি টেকনোলজিতে এগিয়ে থাকবে, তারাই অন্যদের উপর রাজত্ব করবে। খুব সোজাসাপটা হিসাব। এর মধ্যে কোন আইডিওলজিকাল ব্যাপার-সেপার নেই।
স্টীম ইঞ্জিনের মধ্য দিয়ে মানুষের মনোজগতে একটা বড় পরিবর্তন আসলো। দীর্ঘদিন তার বিশ্বাস ছিল, দুনিয়ায় এনার্জি খুবই সীমিত। আর আমরা মানুষেরা সেই এনার্জি সব শেষ করে ফেলতেসি। প্রথমবারের মত তার মধ্যে কনফিডেন্স এলো, যে চাইলেই তো আমরা এক এনার্জিকে আরেক এনার্জিতে কনভার্ট করতে পারতেসি।
কাজেই, এনার্জি সোর্স শেষ হয়ে যাইতেসে—এই ভেবে ভয়ের কিছু নাই। ভয়ের ব্যাপার হবে তখন, যখন এনার্জিকে কনভার্ট করার নিত্যনতুন উপায় আমরা আর বের করতে পারবো না।
মোটরগাড়ি আবিষ্কারের আগে লন্ডনের রাস্তা ঘোড়ার লাদিতে কয়েক ইঞ্চি ঢাকা ছিল। ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, এরকম চলতে থাকলে মানুষ লন্ডন ছেড়ে পালাবে। মানুষ কিন্তু তাপশক্তিকে গতিশক্তিতে রূপান্তরিত করে সেই সমস্যার সমাধান করে ফেলসে। আইনস্টাইন E=mc^2 আবিষ্কার করে দম ফেলার টাইম পান নাই। চল্লিশ বছরের মধ্যেই আমরা পারমাণবিক বোমা বানায়ে ফেলসি। দুনিয়ার জায়গায় জায়গায় নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট বসায়ে ফেলসি।