মিসিসিপি বাবলের ফলাফল দুইটা। এক, এই যে ফ্রান্সের অর্থনীতি কল্যাপ্স করসিলো, প্রায় এক শতাব্দী তা আর এর ধকল কাটায়ে উঠতে পারে নাই। ফ্রান্সের অভিজাতদের দেখে আমাদের ভুল ধারণা হইতে পারে। সাধারণ মানুষের অবস্থা ছিল খুব খারাপ। খুব খারাপ মানে খুবই খারাপ। এক টুকরা রুটির জন্য একজন আরেকজনকে খুন করতো—এই অবস্থা। আই ক্রাইসিসই পরে ফ্রেঞ্চ রেভোল্যুশনের রাস্তা তৈরি করে দেয়।
দুই, ফ্রেঞ্চ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর গোটা ইউরোপের আস্থা উঠে গেলো। এরা আর আগের মত বড় বড় মহাজনদের কাছ থেকে ধার পাইলো না। ফলে, উপনিবেশ নিয়া ফ্রান্স আর ব্রিটেনের মধ্যে যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলতেসিলো, তাতে আগায়ে গেলো ব্রিটেন। কিছুদিনের মধ্যেই অর্ধেক প্থিবীর সম্রাট হিসবে আবির্ভাব ঘটলো ব্রিটিশদের।
ব্রিটিশ পুঁজিপতিরাও প্থিবীকে শান্তি দেয়নি। ব্রিটিশ নাবিকেরা দেশে দেশে তাদের নৌতরী ভিড়িয়েছে। আর ব্রিটিশরাজ চোখ বুজে তার বণিকদের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে। পলাশীর যুদ্ধের কাহিনী তো আমরা সবাই জানি। পলাশীর যুদ্ধ থাক। আজ আমরা আরেকটা যুদ্ধের গল্প শুনি।
ঊনিশ শতকের শুরুর দিক। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন চায়নায় আফিম বেঁচে বেশ দুই পয়সা কামাচ্ছে। এক সময় দেখা গেলো, গোটা জাতি আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। চাইনিজ সরকার নড়েচড়ে বসে। আইন করে আফিম নিষিদ্ধ করে। ব্রিটিশরা তো আর কারো কথা শুনে না। তারা চাইনিজদের মধ্যাঙ্গুল দেখিয়ে ঠিকই ড্রাগের চালান পাঠাচ্ছিল।
গভর্ণমেন্ট তখন কঠোর অবস্থানে যায়। ব্রিটিশ জাহাজগুলোকে জব্দ করা শুরু করে। অনেকগুলো ধ্বংসও করে দেয়। এদিকে ড্রাগ কোম্পানিগুলোতে এমপি-দের একটা বড় শেয়ার ছিল।
এমপি-রা নিজের পেট বাঁচাতে একজোট হয়। ব্রিটিশরাজকে কনভিন্স করে চায়নার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণায়। মুক্ত বাণিজ্যের নামে এ যুদ্ধ হলেও আসলে এটা ছিল অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। যার মূল বক্তব্য হল—আমি তোকে ভাত খাইতে বললে তুই ভাত খাবি। আর আমি তোকে গাঁজা খাইতে দিলে তুই গাঁজা খাবি। দিন শেষে আমার প্রোডাক্টই তোর বাজারে থাকবে।
অসম এ যুদ্ধে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ব্রিটিশরা অনায়াসে জয়ী হয়। চাইনিজরা নাকে খত দিয়ে আফিমের অবাধ ট্রানজিট মেনে নিতে বাধ্য হয়। হংকং তো ব্রিটিশরা পুরোটাই দখল নিয়ে নেয়। দীর্ঘদন এই হংকং ছিল চায়নায় ব্রিটিশ ড্রাগ কার্টেলের মূল বেস।
পুঁজিবাদ এইভাবে গুটিকতক লোকের পকেট ভারি করতে গয়ে সাধারণ মানুষকে বলির পাঁঠা বানিয়েছে। কখনো খোলাখুলি প্রফিটের নামে করেছে। কখনো সেবার নামে। যদিও দুনিয়ায় নন প্রফিট অর্গানাইজেশন বলে কিছু নাই। সবই মানুষকে একটা বুঝ দিয়ে নিজেদের প্রফিট অর্গানাইজেশনের লাভ বাড়ানোর ধান্দা। ট্যাক্স না দেবার ধান্দা।
১৮৭৬ সালে বেলজিয়ামের রাজা মধ্য আফ্রিকার কঙ্গোয় একটা নন প্রফিট অর্গানাইজেশন খুলেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল আফ্রিকা নিয়ে গবেষণা করা আর এখানে যে দাস বাণিজ্য হয়, লাখ লাখ দাসকে যে জাহাজে করে আটলান্টিকের ঐপারে পাঠানো হয়—তা বন্ধ করা। আফ্রিকার জনমানুষের জন্য স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল করাও ছিল এর অন্যতম লক্ষ্য।
কয়েক বছরের মধ্যে এই মানবিক প্রতিষ্ঠানটি দানবিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। যার মূল লক্ষ হয়ে দাঁড়ায় গ্রোথা আর প্রফিট। স্কুল-কলেজ লাটে উঠলো। তার জাউগায় বসানো হল কয়লার খনি আর রাবার বাগান। রাবার ছিল কঙ্গোর প্রধান রপ্তানি পণ্য। পুঁজিবাদের নিয়ম অনুযায়ী, মালিকেরা প্রতি বছর রাবার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা বাড়তো। আর লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলে তার দায় মেটাতে হতো ক্ষকদের তাদের জীবন দিয়ে।
ধারণা করা হয়, ১৮৮৫ থেকে ১৯০৮ সালের মধ্যে ৬০ লক্ষ লোকের ম্ত্যু ঘটে বেলজিয়ান আর্মির হাতে। কারো কারো মতে, এই সংখ্যা ১ কোটি ছাড়িয়ে যাবে।
এইভাবে পুঁজিবাদ মানুষকে বারবার ব্যর্থ করেছে। তাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। তার পরও মানুষ পুঁজিবাদকে ছাড়তে পারেনি। এর কারণ বোধয়, তার কাছে এর চেয়ে ভালো কোন অপশন এখনো আসেনি।
কিংবা পুঁজিবাদ অনেকটা ক্ষির মত একটা টেকনোলজি। শিকারী মানুষ যেমন একবার হাল ধরার পর শত অভাব-অভিযোগ সত্ত্বেও আর শিকারী জীবনে ফিরে যেতে পারেনি, আমরাও পুঁজিবাদের হাজারটা ফাঁক-ফোকড় জেনেও একে ডিভোর্স দিতে পারছি না। আমাদের অর্থনীতি এখন এতোই কমপ্লেক্স যে, চাইলেই আমরা ‘গ্রামে ফিরে যাই’ নীতিতে সবকিছু ছেঁড়েছুঁড়ে সহজ একটা জীবন যাপন করতে পারবো না। বড়জোর যেটা করতে পারি, পুঁজিবাদের গলদ্গুলো শুধরে বেটার কোন মডেলে প্থিবীটাকে দাঁড় করাতে, যেন কঙ্গোর কালো মানুষটা কিংবা চা বাগানের শ্রমিকেরাও তাদের বেসিক চাহিদাগুলো মেটাতে পারে।
১০. বছরের পর বছর চলে গেছে
বছরের পর বছর চলে গেছে। মানুষের চোখের সামনে ব্যাপারটা ঘটেছে। বোকা মানুষ সেটা খেয়াল করে নাই।
একটা কেটলিতে পানি গরম করতে দিয়ে ডেকে দিন। যে মুহূর্তে পানি ফুটে বলক দিবে, সেই মুহূর্তে ধক করে ঢাকনাটা উপরে একটা লাফ দিয়ে উঠবে। পানি বাষ্প হয়ে ঢাকনাটাকে ধাক্কা দিচ্ছে বলেই এটা হচ্ছে। পানির তাপ এখানে ঢাকনার গতিশক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। দুনিয়াজুড়ে লাখ লাখ মানুষ এই ঘটনার সাক্ষী হচ্ছিল প্রতিদিন। অথচ কেউ এর ভেতরে যে বিপুল সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে, সেটা কেউই ধরতে পারে নাই।