অনেকগুলা ক্যারেক্টার আছে এই গল্পে। দেইখেন, ট্র্যাক হারায়ে ফেইলেন না আবার:P
সৈয়দ সাহেব খুবই উঁচু বংশের লোক। ঢাকা শহরে উনার একটা ব্যাঙ্ক আছে।
চৌধুরী সাহেব ঢাকা শহরেরই একজন উঠতি কন্ট্র্যাক্টর। একটা প্রজেক্টে উনি বিরাট লাভ করলেন। সেই লাভের ১ কোটি টাকা উনি সৈয়দ সাহেবের ব্যাঙ্কে রাখলেন। তার মানে সেই ব্যাঙ্কে এখন ১ কোটি টাকার ক্যাপিটাল আছে।
টমি মিয়া তখন ঢাকায় এলেন। এসে খেয়াল করলেন, তিনি শহরের যে অংশে থাকেন, ঐ অংশে কোন ভালো ভাতের হোটেল নাই। সব স্যান্ডউইচ, বার্গার আর ফ্রাইড রাইসে ভর্তি।। নিখাদ ভাত-মাছের দোকান নাই কোন।
টমি মিয়া ঠিক করলেন, এইখানে একটা ভাতের হোটেল দিবেন। কিন্তু হোটেল যে দিবেন, তার জন্য তো টাকা লাগবে। সেই টাকা সে পাবে কই? সে গেলো ব্যাঙ্কের কাছে। ব্যাংকে ভুজুং ভাজুং দিয়ে বুঝাতে সক্ষম হল, যে এইখানে ভাতের হোটেল দিলে বেশ চলবে।
ব্যাঙ্ক তাকে ১ কোটি টাকা লোন দিল। সেই লোন দিয়ে সে কনট্রাক্টর ভাড়া করলো। কাকে করলো? সেই চৌধুরী সাহবেকে যে কিনা ব্যাঙ্কে টাকা রাখসিলো।
চৌধুরী সাহেব সেই টাকা ব্যাঙ্কে ডিপোজিট করলো। এইখান ঠেকে সে দরকারমত চেক ভাঙিয়ে ইট-বালু, রড-সিমেন্ট যা দরকার কিনবে।
মজার ব্যাপার হল, চৌধুরী সাহেবের টাকাই আবার তার এ্যাকাউন্টে ফেরত আসছে। ব্যাঙ্কের হিসাব খাতা দেখাচ্ছে, চৌধুরী সাহেবের এ্যাকাউন্টে এখন ২ কোটি টাকা আছে। সত্যিকার ক্যাশ কিন্তু ঐ ১ কোটিই রয়ে গেছে। টাকা কিন্তু বাচ্চা দেয় নাই।
ঘটনা এইখানেই শেষ না। ২ মাস শেষে কিছুদূর কাজ আগানোর পর কনট্রাক্টর সাহেবের মনে হইলো, যে কাজটা শেষ করতে আরো টাকা লাগবে। সে আরো ১ কোটি টাকার বিল ধরায়ে দিল।
টমি মিয়া বিল দেখে বেজার হইলো। কিন্তু কাজ অনেকখানি আগায়ে গেছে। এখন আর ফেরৎ আসাও ঠিক হবে না। সে আবার ব্যাঙ্কে দৌড় দিলো। ম্যানেজারকে বুঝায়ে সুঝায়ে আরো ১ কোটি টাকা লোনের বন্দোবস্ত করলো। এই ১ কোটি কিন্তু সেই ১ কোটি যেটা কন্ট্র্যাক্টর রড-সিমেন্ট কিনবে বলে ব্যাঙ্কে ডিপোজিট করে রেখেছিল।
যাই হোক, এই লোনের টাকা সে আবার কন্ট্রাক্টরের এ্যাকাউন্টে পাঠালো।
তো, কন্ট্রাক্টরের এ্যাকাউন্টে এখন কতো টাকা হল?
৩ কোটি টাকা। শুরুতে নিজের জমা করা ১ কোটি আর টমি মিয়ার দেয়া ২ কোটি।
আর ব্যাঙ্কে সত্যিকার অর্থে ক্যাশ টাকা আছে কত? সেই ১ কোটিই। যেই ১ কোটি চৌধুরী সাহেব বহু আগে জমা করসিলো।
এই কাজটাই বর্তমান আমেরিকান ব্যাঙ্কিং সিস্টেমে ১০ বার করা যাবে। (বাংলাদেশের সিস্টেমে ক’বার করা যাবে—আমি জানি না। কেউ জানলে জানাবেন, প্লিজ) মানে কন্ট্রাক্টরের এ্যাকাউন্টে ১০ কোটি টাকা দেখানোর জন্য ব্যাঙ্কের ভল্টে ১০ কোটি টাকা থাকা লাগবে না। ১ কোটি টাকা থাকলেই চলবে।
সোজা কথা, আমাদের সবার এ্যাকাউন্টে যে পরিমাণ টাকা আছে, ঐ পরিমাণ ক্যাশ ব্যাঙ্কে নাই। এখন দেশে যদি একটা গুজব উঠে যে সামনে যুদ্ধ, ব্যাঙ্ক সব কল্যাপ্স করবে, ব্যাঙ্কে যার যত টাকা আছে সব উঠায়ে নেও আর দেশের সব মানুষ সেটা বিশ্বাস করে ব্যাঙ্কে টাকা উঠাতে যায়, ব্যাঙ্ক কিন্তু সবার টাকা ফেরত দিতে পারবে না। দিবে কোথ থেকে? থাকলে না দিবে!
এই ব্যাপারটাই ঘটসিলো It’s a wonderful life এর নায়কের সাথে। তার ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে শুনে সবাই টাকা উঠাইতে চলে আসলো। এখন তার কাছে তো টাকা নাই। সে কাস্টোমারদয়ের বুঝাইতেই পারে না, যে সে কোন টাকার ম্যাশিন না । সে একটা সিস্টেম মাত্র। সে X এর টাকা Y কে, Y এর টাকা Z কে আর Z এর টাকা X কে ধার দিয়ে এই সিস্টেমটা চালু রাখসে মাত্র।
এখন এইটাকে আপনি ভণ্ডামি বলতে পারেন। তাহলে গোটা আধুনিক অর্থনীতিই একটা বিরাট ভণ্ডামি।
এক ভণ্ডামি না বলে বরং বলা যায়, ভবিষ্যতের উপর আমাদের অগাধ বিশ্বাস। সৈয়দ সাহেব বিশ্বাস করে যে, টমি মিয়ার হোটেল একবার চালু হয়ে গেলে সেখান থেকে লাখ লাখ টাকা মুনাফা আসবে। সেই প্রফিট থেকে সে আস্তে আস্তে তার ঋণ সুদাসলে শোধ করবে। এক বোল ভাতও সিদ্ধ হয় নাই—তার আগেই সে তাই এই ঝুঁকি নিতে রাজি হইসে।
এই ব্যাপারটাকে আজ আমরা বলি Credit. ল্যাটিন Credo শব্দ থেকে এটা আসছে। এর মানে I trust you. বিশ্বাসটা যতোটা না একজন মানুষের উপর আরেকজনের, তার চেয়ে অনেক বেশি একটা সুখী, সম্দ্ধ ভবিষ্যতের। ব্যাঙ্কার আর হোটেলওয়ালা—দুই জনই একই স্বপ্নে বিশ্বাস করে বলেই এই গোটা সিস্টেমটা কাজ করতেসে। ঐ বিশ্বাসটুকু না থাকলে সিস্টেমটা মুহূর্তে ধ্বসে পড়বে।
ব্যাঙ্ক যদি টমি মিয়াকে লোন না দিত, তখন সে কী করতো? সে এমন কোন কনট্রাক্টর খুঁজে বের করতো, যে কিনা নিজের টাকায় তার হোটেলটা করে দিবে। পরে হোটেল লাভ করা শুরু করলে তার পেমেন্টটা নিবে। সমস্যা হল, এমন কনট্রাক্টর পাওয়া ভূভারতে সম্ভব না। কাজেই, তার হোটেলও বানানো হবে না। হোটেল না হলে মানুষ খেতে আসবে না। তার ট্যাঁকে পয়সা আসবে না। পয়সা ছাড়া সে কন্ট্রাক্টর পাবে না। আর কনট্রাক্টর ছাড়া তার স্বপ্নের হোটেলও হবে না।
যুগের পর যুগ ধরে মানুষ ‘না হবার’ এই দুষ্টচক্রে বন্দী হয়ে ছিল। ইতালির কিছু মানুষ সামান্য Bench এ বসে ধার দেবার যে কালচার শুরু করেছিল, সেই কালচারই ফুলেফেঁপে Bank এর রূপ ধারণ করে মানুষকে এই দুষ্টচক্র থেকে মুক্ত করেছে। আমরা মনে করি, যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ। ব্যাংকারদের ফিলোসফি উলটা। তাদের কথা হচ্ছে—আজকের দিন যেমন তেমন, সামনের দিন সোনার মতন।