ভিনগ্রহী তত্ত্ব এখন পর্যন্ত মেনস্ট্রীম বিজ্ঞানের বাইরের জিনিস। মেইনস্ট্রীম বিজ্ঞানে আসি। বিজ্ঞান বলে, মানুষের হঠাৎ এই বুদ্ধি বেড়ে যাবার ব্যাপারটি নেহাতই জেনেটিক দুর্ঘটনা। এই দুর্ঘটনা নিয়েন্ডারথালদের সাথেও ঘটতে পারতো। সেক্ষেত্রে হয়তো আজ নিয়েন্ডারথালরা আমাদের ফসিল নিয়ে ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করতো।
যাই হোক, এর ফলে একটা ভয়ংকর ব্যাপার ঘটে। আমাদের মস্তিষ্কের সা্র্কিটগুলো একেবারে বদলে যায়। আমাদের চিন্তা করার ক্ষমতা বেড়ে যায় অস্বাভাবিক ভাবে। চিন্তা হচ্ছে অনেকটা ফার্টের মত। চাইলেও একে বেশিক্ষণ আটকে রাখা যায় না। এখন এই নতুন নতুন চিন্তাকে, মনের ভেতরকার ভাবনাকে প্রকাশ করার জন্য তো একটা মাধ্যম প্রয়োজন। সেই মাধ্যমটাই হল ভাষা। সাংকেতিক ভাষা না। একেবারে আদি ও অক্ত্রিম মুখের ভাষা।
এই মুখের ভাষা যে মানুষের একক আবিষ্কার, তা কিন্তু না। আমাদের দূর সম্পর্কের ভাই বানরও কিন্তু স্বল্প পরিসরে হলেও ভাষার ব্যবহার করে। গ্রীন মাঙ্কি নামক একটা প্রজাতির উপর গবেষণা করে বিজ্ঞানীরে দেখেছেন, এরা সিংহ দেখলে সব সময় একটা নির্দিষ্ট আওয়াজ করে। যার মানে, দ্যাখ, দ্যাখ। সিংহ মামা। ঈগল দেখলে সম্পূর্ণ অন্য রকম আওয়াজ করে। যার মানে সম্ভবত, দ্যাখ। দ্যাখ। ঈগল খালা।
মানুষ তাহলে ভাষা আবিষ্কার করে কী বিশেষ সুবিধাটা পেলো? সুবিধাটা এই যে, মানুষের যেহেতু বহু সার্কিটওলা একটি চমৎকার মস্তিষ্ক আছে, সে শব্দের পর শব্দ জোড়া লাগিয়ে সবকিছু অনেক ডিটেইলস বলতে পারে। আমাদের বানর বন্ধু যেখানে বলবে, দ্যাখ, দ্যাখ, সিংহ, সেখানে আমরা বলবো—“পালা মামা, পালা। তোর দশ হাত পিছনে সিংহ।”
তারপর যদি সে বেঁচেবর্তে ফিরতে পারে, সারা জীবন তার জ্ঞাতিগোষ্ঠীর কাছে এই গল্প করে বেড়াবে। কোথায়, কখন সে সিংহটিকে দেখেছিল, সিংহটির গায়ের রঙ কী ছিল, কীভাবে সে বেঁচে ফিরেছে—সব। আর এই করে সেই গোষ্ঠীতে জন্ম নিবে একটি কমন মিথের। এই মিথগুলোই জন্ম দেবে ধর্ম আরা জাতীয়তাবাদের মত মজবুত প্রতিষ্ঠানের।
অনেকে অবশ্য ভাষা আবিষ্কারের পেছনে অন্য একটা গল্পের কথা বলেন আমাদের। ইশারা-ইঙ্গিতে ভাব বিনিময় আমরা মোটামুটি চিরকালই করতে পারতাম। হালকা পাথর ছুঁড়ে শিকার করার যুগে ধরা যাক আপনার সাথে আপনার দলের একজনের দেখে হয়ে গেলো। আপনারা দূর থেকে হাত দিয়ে ওয়েভ করলেন। তাতেই আপনাদের ভাব বিনিময় হয়ে গেলো। সমস্যাটা দেখা দিল মানুষের হাতে যখন ভারী আর সফিস্টিকেটেড অস্ত্র উঠে এলো। তার হাত দুটো অস্ত্র সামলানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এখন অনতিদূরে তার সহচরের সাথে যোগাযোগের উপায় কী? সে তখন তার ভোকাল কর্ডের সাহায্য নিল। মুখ দিয়ে বিচিত্র শব্দ করে বুঝিয়ে দিল—সে এইখানে আছে। তার ছোট্টবন্ধুর ভয়ের কোন কারণ নেই। ধীরে ধীরে এই বিচিত্র শব্দগুলোই একটা স্ট্যান্ডার্ড প্লাটফর্মে এসে ভাষার রূপ নিল।
এই ব্যাপারটাই নিয়েন্ডারথালদের বিরুদ্ধে আমাদের এগিয়ে দিয়েছে। ওদের ভাষা ছিল খুবই প্রিমিটিভ গোছের। দ্যাখ, দ্যাখ, সিংহ আইলো টাইপ। আমরা ততোদিনে কিছুটা সফিস্টিকেটেড ভাষা রপ্ত করে ফেলেছি। আর আপনি যতো কমপ্লেক্স ভাষা রচনা করতে পারবেন, আপনার পক্ষে প্ল্যান-প্রোগ্রামও করা ততো সুবিধা হবে। দ্বিতীয়বার যখন হোমো সেপিয়েন্সরা নিয়েন্ডারথালদের মোকাবেলা করে, সেই মোকাবেলা শুধু অস্ত্রের মোকাবেলা ছিল না। সেটা ছিল ভাষা নামক নতুন টেকনোলজির অস্তিত্বের জন্য এক বড় রকমের পরীক্ষা।
নিয়েন্ডারথালরা যেখানে তাদের বেসিক ইন্সটিংক্ট দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, আমরা সেখানে যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করে ময়দানে গিয়েছি। হয়তো একজন দলছুট হয়ে বিপদে পড়েছে। সে চিৎকার করে ডাক দিয়েছে—“ওরে রাম, শ্যাম, যদু, মধু—এই আমগাছের তলায় আয়। আমারে বাঁচা।” সঙ্গে সঙ্গে রাম, শ্যাম, যদু, মধু তাঁকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে। আর এইখানেই নিয়েন্ডারথালরা পিছিয়ে পড়েছে। নিজেদের মধ্যে কম্যুনিকেশন স্যাটেলাইট গড়ে তুলতে না পারায় তারা বহুদিনের অধিক্ত ইউরোপ তো হারিয়েছেই, সেই সাথে নিজেরাও হারিয়ে গেছে।
ভাষার উত্থানের পেছনে আরেকটা থিওরি আছে। আর এটাই সবচেয়ে জোরালো থিওরি। এই থিওরি বলে, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সিংহ আইলো কি আইলো না—এটা জানা যতোটা জরুরী, তার চেয়ে অনেক বেশি জরুরী তার পাশের মানুষটা তার আড়ালে কী করছে, কী ভাবছে, কার সাথে শুচ্ছে—এইসব জানা। এইসব খবর সংগ্রহের জন্য তাকে ত্তীয় আরেকটা মানুষের সাথে কথা বলতে হবে; সোজা কথায় পরচর্চা করতে হবে। পরচর্চা থেকেই সে জানতে পারবে—তার দলের কোন লোকটা ভাল মানুষ আর কোন লোকটা দুই নম্বর। কাকে বিশ্বাস করা যায় আর কাকে করা যায় না।
শুনতে অদ্ভূত শোনালেও তথ্যপ্রমাণ এটাই বলে, পরচর্চাই আদিম মানুষের ভাষার বুনিয়াদ গড়ে তুলেছে। ছোট ছোট দল বা গোষ্ঠীকে একত্র করে গড়ে তুলেছে স্থায়ী, বড় সমাজ। এমনকি আজকের যুগেও এটা সত্য। পাঁচজন প্রফেসর যখন কোথাও ডিনার করতে যান, তারা যে সবসময় বিজ্ঞান নিয়েই কথা বলেন—তা কিন্তু না। ডিপার্টমেন্টের হেড নতুন জয়েন করা সেক্রেটারিরি সাথে শুচ্ছে কিনা—এটাও তাদের আলোচ্য বিষয়বস্তুতে থাকে।