অজ্ঞতা আবার দুই রকমের। ইম্পর্ট্যান্ট বিষয়ে অজ্ঞতা। আর আনইম্পর্ট্যান্ট বিষয়ে অজ্ঞতা।
ইম্পর্ট্যান্ট কিছু তোমার জানা নাই থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে বিধান হচ্ছে, তুমি জ্ঞানী কোন লোকের কাছে যাবা এই প্রশ্নের উত্তর জানতে। আমি সামান্য মানুষ। দিন আনি দিন খাই। এখনা আমার মনেও তো প্রশ্ন আসতে পারে—এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কেমনে তৈরি হইলো? ৫০০ বছর আগে হইলে আমি প্রশ্নের উত্তর জানতে চলে যাইতাম এলাকার হুজুরের কাছে। তিনি কোরান ঘেঁটে আমাকে হয়তো একতা জবাব দিতেন।
ইম্পর্ট্যান্ট বিষয়ের জ্ঞান না হয় জ্ঞানীগুণীদের কাছ থেকে পাওয়া গেল। আনইম্পর্ট্যান্ট যে বিষয়গুলা—ওগুলা জানা যাবে কীভাবে? কিছু আজাইরা বিষয় আছে, যেগুলো হয়তো সমাজের কেউই, একজন আদম সন্তানও জানে না। কিন্তু ঐ বিষয়েও তো কারো জানার আগ্রহ থাকতে পারে।
ধরেন, মাকড়সা কেমনে জাল বোনে, কবে থেকে কী পরিস্থিতিতে তারা জাল বোনা শুরু করসে—এটা আমার জানার খুব ইচ্ছা। এলাকার হুজুরকে এটা জিজ্ঞেস করে তো লাভ নেই। কেননা, কোরানে এর কোন জবাব নেই। তার মানে এই না যে, কোরান একটা অসম্পূর্ণ গ্রন্থ। তার মানে এই যে, এইসব তুচ্ছ বিষয় নিয়া আল্লাহ মাথা ঘামান নাই। কাজেই, এইসব আজাইরা বিষয় আমাদের না জানলেও চলবে।
আধুনিক বিজ্ঞান অজ্ঞতার এই ধারণাকে অস্বীকার করে। সে বলে, মাকড়সা কেমনে জাল বোনে—এর মধ্যেও অনেক অনেক রহস্য লুকায়ে থাকতে পারে। কাজেই এর গবেষণার পিছনেও সে মিলিয়ন ডলার খরচ করতে রাজি আছে।
মুহম্মদের দেয়া জীবন পদ্ধতিকে আমরা সর্বশেষ way of life বলে জানি। আমরা কীভাবে জীবন যাপন করবো–তার সব কিছু এখানে বলে দেয়া হয়েছে। মুহম্মদের মধ্য দিয়ে তাই নবী-রাসূল আআর যে পাইপলাইন, তা বোধ করে দেয়া হয়েছে। একে আমরা ‘খতমে নবুওয়্যত’ বলে জানি।
আধুনিক বিজ্ঞানে এই ‘খতম’ ব্যাপারটার কোন স্থান নেই। সে কখনো বলে না, যে ডারউইনের মধ্য দিয়ে ‘খতমে বায়োলিজত’ হয়েছে। কিংবা আইন্সটাইনের মধ্য দিয়ে ‘খতমে ফিজিক্সত’ হয়েছে। কেননা, ব্রেন কীভাবে ডেভেলপ করেছে আমরা জানি, কিন্তু এই ব্রেন কীভাবে আমাদের মধ্যে বোধ বা চেতনা তৈরি করে—আমরা জানি না। বিগ ব্যাং হয়েছে–আমরা জানি। কিন্তু কীভাবে এই বিগ ব্যাং হল—আমরা এখনো ঠিক জানি না।
স্বভাবতই, আধুনিক বিজ্ঞানে পীরবাদের কোন স্থান নেই। এইখানে নিউটনের পেপারের ভুল ধরেন আইনস্টাইন, আইনস্টাইনের পেপারের অন্য কেউ। নিউটন ‘নিউটন’ হইসেন বলে তার মন্দির বানায়া আমরা পূজা করবো—ব্যাপারটা এমন না। ব্যক্তি বা থিওরির পূজা এইখানে নিষিদ্ধ।
আধুনিক বিজ্ঞানের মজাটা এইখানেই। আপনি যতো ভালো থিওরিই দেন না কেন, বিজ্ঞানে ন্যূনতম জ্ঞান আছে, এমন যে কেউ তথ্য প্রমাণ নিয়ে আপনাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে। ইকোনমিস্টদের যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় প্রায়ই। আপনি যতো ভালো ইকোনমিক মডেল নিয়েই আসেন না কেন, একটা ফাইন্যানশিয়াল ক্রাইসিস বা শেয়াল বাজার ক্রাশের পর আপনাকে সবাই কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেই।
চ্যালেঞ্জ করার এই অধিকার আছে বলেই আধুনিক বিজ্ঞান এখনো এতো ডাইন্যামিক। নিজের অজ্ঞতাকে সে বুক ফুলিয়ে স্বীকার করে। অবশ্য এই ডাইন্যামিজম-এর কিছু সাইড ইফেক্টও আছে।
ধরা যাক, বিজ্ঞান প্রমাণ করলো যে আল্লাহ বলে কেউ নাই। এখন যে সোশ্যাল অর্ডার ঈশ্বরে বিশ্বাসী হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতো—সে সমাজকে আপনি ধরে রাখবেন কীভাবে? সমাজকে ধরে রাখার জন্য তো একটা গল্প শুনাতে হবে। সেই গল্প আপনি পাবেন কই?
রাশিয়ানরা একটা গল্পের আশ্রয় নিসিলো। তারা বলতো, কার্ল মার্ক্স যে ইকোনমিক মডেল দিসেন—সেটাই পরম সত্য। এইটা দিয়েই আমাদের ইহকাল সুখে শান্তিতে চলে যাবে। আর পরকাল বলে তো কিছু নাই-ই। কাজেই, আমাদের আর অন্য সত্য খোঁজা লাগবে না। দুঃখজনকভাবে, এই গল্প বেশিদিন চলে নাই।
বেশি দিন চলে নাই জার্মান নাৎসিদের গল্পও। তারা বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণ করে ফেলসিলো, যে তারাই দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ জাত। নাৎসিরা বিজ্ঞান মানতো, কিন্তু বিজ্ঞানের সমালোচনা মানতো না। বিজ্ঞানের মূল সার যে কেবল আবিষ্কার না, আবিষ্কারের ক্রিটিসিজম শোনাও—এই তত্ত্বে তাদের বিশ্বাস ছিল না। ক্রিটিসিজম না শোনার ফলাফল তো তারা নিজে চোখেই দেখেছে।
আধুনিক সমাজ এই সমস্যার সমাধান করার জন্য লিবারেল হিউম্যানিজমকে বেছে নিয়েছে। বিজ্ঞান আর বিশ্বাস আলাদা থাকবে—এটাই এই চিন্তাধারার মূল কথা। এরা বলে, বিজ্ঞান বিজ্ঞানের মত চলুক। তুমি যদি ব্যক্তিগত পর্যায়ে কোন বিশ্বাস নিয়ে থাকতে চাও তো থাকো। সেটা যদি বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ও, বিজ্ঞান তাতে কোন বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।
০৯. পৃথিবীর মোট সম্পদের মূল্যমান
পাঁচশো বছর আগে গোটা পৃথিবীর মোট সম্পদের মূল্যমান ছিল ২৫০ বিলিয়ন ডলারের মত। আজ সেটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ৬০ ট্রিলিয়ন ডলার।
কেবল মানুষ বাড়সে বলেই কি সম্পদের এই বিস্ফোরণ? উহুঁ।
সেসময় মাথা পিছু মানুষের উৎপাদন ছিল বছর প্রতি ৫৫০ ডলার। এখন যেটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ৮,৮০০ ডলার।
এই যে ভয়ানক গ্রোথ, এর পেছনে কারণটা কী?
কারণটা আর কিছুই না, আধুনিক অর্থনীতি। আধুনিক অর্থনীতি খুব জটিল একটা ব্যাপার। জটিল ব্যাপারকে সহজ করার জন্য একটা গল্প শোনাই বরং।