গোলটা বাঁধলো অন্য জায়গায়। শনিবার ছিল ইহুদীদের জুম্মাবার। শুক্রবার সন্ধ্যায় র্যাবাই গোলেমকে লক করে রাখতেন। এক শুক্রবার সন্ধ্যায় তিনি এটা করতে ভুলে গেলেন।
এর মধ্যে কেউ একজন গোলেমের বুকের ম্যাজিক সিম্বল চুরি করতে গেলে সে রেগে যায়। রেগেমেগে সে ঘেটোতে আগুন লাগিয়ে দেয়। দাউদাউ করে চারদিক জ্বলতে থাকে।
মরাল অফ দ্যা স্টোরি—মানুষ যতোবারই গোলেম বানাতে গেছে, সফল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই গোলেমকে নিজের কন্ট্রোলে রাখতে পারেনি।
পুরাণ এইভাবে মানুষকে তার সীমাবদ্ধতার কথা, তার দুর্বলতার কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। প্যারাডক্সটা হচ্ছে এই যে, মানুষ পুরাণকথা শুনতে চায়। কিন্তু মিথ বা পুরাণকাহিনী শুনিয়ে তাকে ডিমোটিভেট করা যায় না। সে আকাশে উড়বেই।
আজ মানুষ স্পেসশিপে করে চাঁদে গিয়েছে। মঙ্গলে যাচ্ছে। ইকারাসের মত ঝলসে যায়নি। বুর্জ খলিফা বানিয়ে আকাশ ছুঁয়েছে। আরব ভূমিতে এসে ইংরেজভাষী ডিজাইনার এটা বানিয়ে গেছে। ভাষা এখানে কোন বাধাই হয়ে দাঁড়ায়নি। আর গোলেম তো আমরা হরদম দেখি। আপনি যে কম্পিউটার বা ল্যাপটপের সামনে বসে আছেন, সেও এক রকমের গোলেম। আর সবচেয়ে বড় গোলেম হচ্ছে রোবট।
মানুষ বরাবরই চেয়েছে ঈশ্বরের সমকক্ষ হতে। আধুনিক মানুষ সেটা পেরেছেও। বিজ্ঞান নামক ম্যাজিক বাক্সকে সঙ্গী করে একে একে সব অসম্ভবকে সম্ভব করেছে সে।
যে ডিপার্টমেন্টগুলো একদিন ছিল ঈশ্বরের একান্ত নিজস্ব, মানুষ সেই সব ডিপার্টমেন্টে হানা দিয়েছে। বজ্র যেমন ছিল ঈশ্বরের অস্ত্র। এই অস্ত্র দিয়ে পাপী তাপীদের ঘায়েল করতেন তিনি।
বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন বজ্রপাতের সময় ঘুড়ি উড়িয়ে প্রমাণ করলেন, বজ্র আর কিছুই না। ইলেকট্রিক কারেন্ট মাত্র। ইলেকট্রিসিটির মূলনীতি কাজে লাগিয়ে তৈরি করলেন বজ্রনিরোধক দণ্ড। ঈশ্বরের অস্ত্র এবার মানুষের হাতে চলে এল। বিদ্যুতের সোল ডিস্ট্রিবিউশনের উপর থেকে এখতিয়ার হারালেন মহামান্য ঈশ্বর।
মানুষের ইতিহাস তাই ঈশ্বরের নিরস্ত্র হবার ইতিহাস।
প্থিবীর ইতিহাস ঈশ্বরের ক্ষমতায় মানুষের ভাগ বসানোর ইতিহাস।
আমাদের দেশে প্রশ্ন করাকে খুব একটা ভালো চোখে দেখা হয় না। অজ্ঞতাকে তো না-ই। অজ্ঞতা এক রকমের অপরাধ এইখানে। যে টপিকটা স্কুলে শিখে আসার কথা, সেটা ঠিকঠাক শিখে না আসলে কলেজে এসে আমাদের স্যারদের হাতে নাকানিচুবানি খাইতে হয়। “এইটা জানো না? স্কুলে কী শিখসো তাইলে?” কিংবা “স্কুলের স্যাররা কী শিখাইসে?”—এগুলো তো খুবই কমন কোশ্চেন। কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জব লাইফ পর্যন্ত অজ্ঞতাকে উপহাস করার এই সাইকেল চলতে থাকে।
আমরা যতোটা সময় শেখা বা শেখানোয় ব্যয় করি, তার চেয়ে অনেক বেশি সময় ব্যয় করি অন্যের অজ্ঞতা নিয়ে উপহাস করায়।
আমাদের দেশে যেখানে অজ্ঞতাকে উপহাস করা হয়, পশ্চিমে সেখানে অজ্ঞতাকে রীতিমত সেলিব্রেট করা হয়। আমাদের এখানে প্রশ্ন করা যেখানে পাপ, পশ্চিম সেখানে প্রশ্নের জন্য মুখিয়ে থাকে। সে যতো লেইম প্রশ্নই হোক না কেন! আমাদের ল্যাবে তো একটা কথা প্রায়ই বলা হয়—No question is a silly question. জ্ঞানের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়েও যে তোমার অনেক কিছুই অজানা থাকতে পারে—এইটুকু মনে করিয়ে দিতেই এই রিমাইন্ডার।
পশ্চিমা সভ্যতা ফল করতেসে সবাই বলে। তারপরও আমরা পশ্চিমেই যেতে চাই। পূর্বে না। তার একটা বড় কারণ বোধয় প্রশ্ন করার এই অবাধ স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতাটুকু আছে বলেই নোয়াম চমস্কির মত স্ট্রাকচারের বাইরের মানুষরাও এখানে খেয়েপরে বাঁচতে পারেন, কেউ তাদের গলা কাটতে আসে না। এইটুকু স্বাধীনতাটুকু যদ্দিন থাকবে, তদ্দিন পশ্চিম চোখ বুঁজে প্থিবীকে লীড করবে।
হ্যাঁ, সভ্যতার স্বাভাবিক নিয়মেই হয়তো এই সভ্যতাও একদিন ফল করবে। যেমনটা করেছিল রোমান বা অটোমান সভ্যতা। তবু রোমান বা অটোমানদের সাথে এই সভ্যতার একতা বেসিক পার্থক্য আছে। এই সভ্যতা গড়ে উঠেছে আধুনিক বিজ্ঞানকে সম্বল করে। বিজ্ঞান আমাদের যে টুলগুলো দিয়েছে, সেই টুল্গুলোকে নয়, যে নতুন চিন্তাধারা দিয়েছে সেই চিন্তাধারাকে সম্বল করে।
আধুনিক বিজ্ঞান কখনোই বলে না যে—আমরা সব কিছু জানি। বরং বারবার এটাই বলে যে, ‘আমরা অনেক কিছুই জানি না’। না জানাটাই সুন্দর। না জানাটাই পবিত্র। কেননা, ‘জানি না’, এটা যখন স্বীকার করবো—তখনই নতুন কিছু জানার আগ্রহ তৈরি হবে।
জানি না—এই বোধ যখন আমার মধ্যে আসবে, তখনই আমি জানার জন্য নতুন নতুন এক্সপেরিমেন্ট করবো। ডাটা কালেক্ট করবো। ম্যাথমেটিক্যাল টুলের সাহায্যে সেই ডাটাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো। আর আধুনিক বিজ্ঞান এইখানেই থেমে থাকে না। সে নলেজকে কাজে লাগিয়ে সে নতুন নতুন অস্ত্র বানা্য। অস্ত্র মানে খালি AK-47 না। টেলিভিশন এক রকমের অস্ত্র। ওষুধ এক রকমের অস্ত্র। হালের ক্ল্যাশ অফ ক্ল্যানও এক রকমের অস্ত্র যদি আপনি কাজে লাগাইতে পারেন।
আধুনিক বিজ্ঞানে যে বিপ্লব ঘটিয়েছে, সেটা আসলে জ্ঞানের বিপ্লব না। সেটা অজ্ঞতার বিপ্লব। মানুষ বিপুল উৎসাহে আবিষ্কার করসে—সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট প্রশ্নগুলোর উত্তরই তার জানা নাই। কাজেই, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে সে পথে বেরিয়ে পড়েছে।