খেয়াল করে দেখেন, সেইফ খেলতে গিয়ে আপনি নিজের কিছুটা হলেও ক্ষতি করছেন। গেইম থিওররি মূলকথা এটাই। নিজেদের ক্ষতি হবে জেনেও আমরা এমন কিছু করি, যাতে অন্যেরও অল্প বিস্তর ক্ষতি হয়। নিজের ক্ষতিটুকু তখন আর অতো গায়ে লাগে না।
বাস্তব জীবনটাও এমনই। আপনাকে সবসময়ই এমন দুটো অপশন দেয়া হবে যার একটা খারাপ আর একটা বেশি খারাপ। আপনি তখন মন্দের ভালোটাকেই বেছে নিতে বাধ্য হবেন। বাংলাদেশ বা আমেরিকার নির্বাচনে যেটা বরাবরই হয়ে আসছে। ভালো অপশন বলে দুনিয়ায় কিছু নেই। ‘ভালো’ একটা মিথ।
অস্ত্রের দৌড়ই ধরি না কেন! এই দৌড়ে কারোরই কোন লাভ হয় না। উলটা দেশ, জনগণ—সবাই পথে বসে। তাও রাষ্ট্র সেইফ থাকার জন্য এই দৌড়ের লোভ সামলাতে পারে না। পাকিস্তান যখন দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কেনে, তখন ভারতও কিনতে বাধ্য হয়। নাইলে মান সম্মান থাকে না। আবার ভারত যখন পারমাণবিক বোমা বানায়, তখন পাকিস্তানও তার জনগণকে না খাইয়ে না পড়িয়ে হলেও বোমা বানায়। দিন শেষে দু’জনের এ্যাবসোলিউট ক্ষমতা আগের চেয়ে বাড়ে হয়তো, রিলেটিভ ক্ষমতা আগে যা ছিল–তাই থাকে। মাঝখানে অস্ত্রের দৌড়ের জয় হয়। ভাইরাস যেভাবে নিজেকে বিস্তার করে, অস্ত্রের দৌড়ও আমাদের মাথায় কিলবিল কিলবিল করে নিজেকে বিস্তার করে নেয়।
সোজা কথা হচ্ছে,কেউ আমাদের ভাল চায় না। সে গেমই হোক আর মিম-ই হোক। সবাই যার যার ধান্দায় ব্যস্ত। সারাজীবন নিজেদের স্বার্থে আমাদের ইউজ করে কেবল। আর ইউজ শেষ হলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
দাইদ্যালুস ও আইকারুসের গল্প তো আমরা সবাই জানি।
ঐ যে! রাজার রোষ থেকে বাঁচার জন্য দাইদ্যালুস মোমের তৈরি পাখায় ভর করে আকাশপথে সমুদ্র পাড়ি দেবার প্ল্যান করে। ছেলে আইকারুসকে নিয়ে পাখার পিঠে চড়েও বসে। আইকারুস ছেলে মানুষ। রক্তে তারুণ্যের বান। সে অতি আবেগে আপ্লুত হয়ে সেই ডানায় করে সূর্যের কাছাকাছি চলে যায়। ফলাফল, সূর্যের তাপে তার ডানা ভস্ম হয়ে যায়।
সাথে মানুষের আকাশ পাড়ি দেবার স্বপ্নটাও।
আকাশে ওরা জিবরাইলের কাজ, ইকারাসের নয়। মানুষ যখনই ঈশ্বরের ক্ষমতাকে এভাবে ছুঁতে চেষ্টা করেছে, তখনই সে ধ্বংস হয়েছে। তাকে ইনডিরেক্টলি বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে—তুমি সামান্য মানুষ। এসব তোমার কাজ নয়।
তবু মানুষ বারবার বিপথে গেছে। নূহের বন্যার অনেক দিন পর তার বংশধররা শিনার নামে এক জায়গায় বসতি গড়ে। এই সবুজকে কেন্দ্র করে তারা একটা শহর গড়বার স্বপ্ন দেখে। সেই শহরের মধ্যিখানে থাকবে এক আকাশছোঁয়া মন্দির।
ঈশ্বর ভাবলেন—আমাকে ছোঁবে? এতো বড় সাহস। ঈশ্বরের অহমে ঘা লাগলো। তিনি ঠিক করলেন, এই প্ল্যান ভেস্তে দিতে হবে। কিন্তু কীভাবে?
সর্বশক্তিমান ঈশ্বর চাইলেই বন্যা বা ভূমিকম্প দিয়ে এই প্ল্যান ভেস্তে দিতে পারতেন। তিনি তা করলেন না। উনি এক সূক্ষ্ম চাতুরির আশ্রয় নিলেন এইবার।
সেকালে দুনিয়ার সব মানুষ একই ভাষায় কথা বলতো। ঈশ্বর তাদের মুখে নানা রকম জবান ঢুকিয়ে দিলেন। যে শ্রমিকেরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছিল, তারা আর একে অন্যের কথা বুঝতে পারলো না। ইট আনতে বললে আনে বালু, বালু আনতে বললে সুড়কি। তৈরি হল ব্যাপক কনফিউশন।
অগত্যা মন্দির নির্মাণের চেষ্টা বাদ দিয়ে এক এক দল এক এক দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো। ঈশ্বর থাকেন উঁচুতে। অনেক উঁচুতে। বোঝা গেল, তার উচ্চতায় পৌঁছানোর চেষ্টা কখনোই ভালো ফল বয়ে আনে না।
এখানেই শেষ নয়। এমন চেষ্টা ঈশ্বরের প্রিয় বান্দা ইহুদীরাও করেছিল।
ঈশ্বর কাদামাটি দিয়ে মানুষ তৈরি করেছেন। সেই মানুষ কথা বলে, হাঁটে, টুকটাক কাজকর্মও করে। মানুষের পক্ষে কি সম্ভব ঈশ্বর হওয়া? সেও কি পারবে কাদামাটি দিয়ে এমন কিছু তৈরি করতে যে কথা বলবে, হাঁটবে, টুকটাক কাজকর্মও করবে?
ইহুদীদের পুরাণ বলে, হ্যাঁ। সম্ভব। ইহুদী পুরাণে তাই গোলেম নামক এক স্ষ্টির কথা বারবার এসেছে। (গোলামের সাথে মিল পাচ্ছেন কি?)
ইহুদী পুরাণ বলে, খোদা স্রেফ মুখের কথা দিয়ে মানুষ তৈরি করেছেন। তিনি বললেন, “হও”। আর হয়ে গেছে। ইহুদী মিস্টিসিস্টরা ঠিক একই রেসিপিতে গোলেম তৈরি করতে চাইলেন। এক চা চামচে এক মুঠ বালি নিয়ে তাতে যথাযথ মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিলে সেই বালু থেকে শূন্যের মধ্যে গজিয়ে উঠবে একটি মূর্তি।
গোলেম কাহিনীর সবচেয়ে বাজার চলতি ভার্সনটা পাওয়া যায় প্রাগে।
মধ্যযুগের কথা। সেখানকার এক র্যাবাই (ইহুদী হুজুর) মন্ত্রটন্ত্র পড়ে গোলেম তৈরিই করে ফেললেন। কিন্তু গোলেমের সাইজ তার নিয়ন্ত্রণে থাকলো না। বড় হতে হতে সেটার মাথা ছাদ ছুঁইয়ে ফেলছিলো প্রায়। র্যাবাই তো দেখেন সর্বনাশ। বাড়িঘর সব ভেঙে তার মাথার উপর পড়বে।
তিনি তখন বুদ্ধি করে একে মাথা নিচু করে তার জুতার ফিতা বাঁধতে বলেন। যখনই মাথা নিচু করে তার হাতের নাগালে আসবে, তখনই তার কপাল থেকে ম্যাজিক সিম্বলটি খুলে নিবেন। এই ম্যাজিক সিম্বলই যতো নষ্টের গোড়া। এটা খুলে নিলে ব্যাটা মাটির তাল ছাড়া আর কিছুই না।
এইখানেই র্যাবাই ভুল করে ফেললেন। সিম্বলটি উঠিয়ে নেয়া মাত্র গোলেমটি হুড়মুড় করে র্যাবাইর মাথায় ভেঙে পড়ে। স্ষ্টির হাতে ম্ত্যু হয় স্রষ্টার।
এই গল্পের আরেকটা ভার্সন আছে। প্রাগ থেকে তখন ইহুদীদের তাড়িয়ে দেয়ার একটা ষড়যন্ত্র চলছিলো। র্যাবাই মহারাল ভাবলেন, এই গোলেমের সাহায্যে তিনি ইহুদীদের রক্ষা করবেন। করলেনও। প্রাগে ইহুদীরা থেকে গেলো।