ইতিহাসবিদরা সবসময়ই আমাদের ‘কীভাবে হল’—এর উত্তর দেন। ‘কেন হল’—এর উত্তর খুব কমই দেন। তারা একের পর এক ঘটনাসূত্র মিলিয়ে এমনভাবে গল্পটা বলেন—যেন এমনটাই হবার কথা ছিল। কিন্তু একটা সূত্র মিস হয়ে গেলে কী ঘটতে পারতো—সেটা তারা খুব কমই বলেন। ধরা যাক, ভারত একাত্তরে আমাদের এক কোটি শরণার্থী নিল না। সেক্ষেত্রে কি আমরা নয় মাসেই স্বাধীনতা পেতে পারতাম? নাকি ভিয়েতনামের মত সাত-আট বছর যুদ্ধ করে স্বাধীনতা পেতাম? নাকি ফিলিস্তিনের মত আমাদের ধুঁকে ধুঁকে মরতে হত? স্বাধীনতার স্বাদ আমাদের আর পাওয়াই হত না।
জিয়াউর রহমান রাজাকার তোষণ করেছেন। জিয়াউর রহমান না এসে যদি কর্ণেল তাহের বা খালেদ মোশাররফ ক্ষমতায় আসতেন, তারা যে কেউ রাজাকার তোষণ করতেন না—তার গ্যারান্টি কী? বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে উনি নিজেই যে এক সময় ধর্মভিত্তিক রাজনীতির দিকে ঝুঁকে যেতেন না—এরই বা নিশ্চয়তা কে দেবে?
সমস্যাটা হচ্ছে, একটা ঘটনা যখন ঘটে, তখন সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষটিও পরের ঘটনার ব্যাপারে সম্পূর্ন ক্লুলেস থাকে। সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করা তো দূরের কথা। টকশোতে করা বুদ্ধিজীবীদের বয়ান যে বারেবারে ভুল প্রমাণিত হয়, এই কারণেই হয়। এটা যেমন অতীতের জন্য সত্য, তেমনি বর্তমানের জন্যও। আজ আমরা ভাবছি, আমেরিকা ফল করলে চায়না তার জায়গা নেবে। পঞ্চাশ বছর পর চায়নার জায়গায় যদি ব্রাজিল আমেরিকার জায়গা দখল নেয়, তখন ইতিহাসবিদরা ঘটনাগুলোকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করবে, যেন ব্রাজিলই ছিল অবশ্যম্ভাবী রিপ্লেসমেন্ট। অথচ ব্রাজিলকে এখনো কেউ গোনায় ধরছে না।
কনস্ট্যানটিন রোমের সিংহাসনে আরোহণ করেন ৩০৬ খ্রিস্টাব্দে। সেই সময় খ্রিস্টধর্মকে ইহুদী ধর্মের একটা ক্ষুদ্র সেক্টের বেশি ভাবা হতো না। সেই সময় কেউ যদি এমনটা প্রেডিক্ট করতো যে, আর কয়েক বছরের মধ্যেই খ্রিস্টধর্ম হবে রোমান সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রধর্ম—তাকে পাগল ছাড়া কিছু ভাবা হত না। আপনি যদি এখন প্রেডিক্ট করেন—২০৫০ সালে আমেরিকার রাষ্ট্রধর্ম হবে হিন্দু ধর্ম—আপনার বন্ধুই আপনাকে বলবে, তোর মাথা ঠিক আছে তো? ১৯১৩ সালে বলশেভিকরা ছিল রাশিয়ার একতা ক্ষুদ্র উপদল। ধরেন আমাদের বামফ্রন্ট। এরা যে ৪ বছরের মধ্যে একটা বিপ্লব ঘটায়ে রাশিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতায় চলে আসবে—এটা ছিল কল্পনারও অতীত। আরব বেদুইনদের ধর্ম যে এদিকে দিল্লীর গেট আর ঐদিকে বসফরাস প্রণালী পর্যন্ত চলে আসবে—সেটাই বা কে ভেবেছিল?
আমরা যারা নিজেদের যুক্তিবাদী মানুষ হিসেবে ভাবতে ভালোবাসি—তারা মনে করি ইতিহাসও বোধ করি এই যুক্তির পথ ধরে চলবে। একটা ঘটনার ফলাফল হিসেবে আরেকটা ঘটনা ঘটবে। ইতিহাসের মশকরা হচ্ছে এই যে, ব্যাটা কোন যুক্তি-টুক্তির ধার ধারে না। কোন একটা সময়ে এতো বেশি ফোর্স কাজ করে আর এতো বেশি ভ্যারিয়েবল ইনভল্ভড থাকে—যে আপনি কোন ইকুয়েশন বা সিস্টেম অফ ইকুয়েশন দিয়েও গোটা পরিস্থিতিটা ব্যাখ্যা করতে পারবেন না। ক্যাওসের অপর নাম এই ইতিহাস।
ক্যাওস দুই রকমের আছে। লেভেল ওয়ান ক্যাওস আর লেভেল টু ক্যাওস।
লেভেল ওয়ান ক্যাওস হচ্ছে সেইসব ঘটনা যা আপনার প্রেডিকশনকে থোড়াই কেয়ার করবে। আপনি যাই বাণী দেন না কেন, সে তার মত করে ঘটে যাবে। আবহাওয়া যেমন। ব্ষ্টি হবে কি হবে না—এইটা প্রেডিক্ট করার জন্য আপনি হাজারটা কম্পিউটার মডেল খাড়া করাতে পারেন। সেই মডেলে আপনি যতো বেশি প্রিভিয়াস ইনপুট দিবেন, মডেল ততো এ্যাকিউরেট হবে। কিন্তু কখনোই ১০০% এ্যাকিউরেট হবে না।
লেভেল টু ক্যাওস হচ্ছে উল্টাটা। আপনার প্রেডিকশনকে সে পাত্তা দিবে। আর সেই মত রেসপন্স করবে। তেলের বাজার যেমন। ধরা যাক, আপনি অনেক খেটেখুটে একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম দাঁড় করাইলেন, যেটা তেলেক্র দামের ১০০% সঠিক প্রেডিকশন দিবে।
আজকে বাজারে তেলের দাম গ্যালন প্রতি ৪০০ টাকা। আপনার প্রোগ্রাম বললো, কালকে দাম বেড়ে ৫০০ টাকা হবে। কাজেই, দাম বাড়ার আগেই আপনি তেল কিনতে গেলেন স্টেশনে। আপনার মত আরো অনেকেই গেল। বিক্রেতা তো তেলের এই চাহিদা দেখে আজকেই দাম বাড়ায়ে ৫০০ টাকা করলো। খেয়াল করে দেখেন, প্রোগ্রাম বলসিলো— কাল দাম বেড়ে হবে ৫০০ টাকা। আপনাদের তাড়াহুড়ার কারণে সেটা আজকেই ৫০০ টাকা হয়ে গেল। ১০০% এ্যাকিউরেট প্রোগ্রাম কিন্তু এখানে ফেল মারলো।
তেলের বাজার আর রাজার বাজারে এইখানে কোন তফাৎ নাই। অনেকে আরব বা মার্কিন বুদ্ধিজীবীদের দোষ দেয়–তারা কেন আরব বসন্তের ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারলো না। আরে বাবা, কোন বিপ্লবই ভবিষ্যদ্বাণী মেনে হয় না। এটা ইউসুফ নবীর সময় না যে, আপনি আগে থেকে দুর্ভিক্ষের প্রেডিকশন করে রাখবেন, সেই মত খাদ্যশস্য জমায়ে রাখবেন আর দুর্ভিক্ষ এলে সেই শস্য দিয়ে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ করবেন।
আর ধরা যাক, আমরা কোন এক পলিটিক্যাল জিনিয়াসের সন্ধান পেয়েছি। যিনি ইউসুফ নবীর মতই ভবিষ্যৎ দেখেন। ২০১০ সালে (আরব স্প্রিং এর এক বছর আগে) তিনি মিশর প্রধান হোসনি মোবারকের কাছ থেকে টেকাটুকা খেয়ে একটা পলিটিকাল এলগরিদম দাঁড় করালেন। প্রোগ্রাম রান করে তিনি মোবারককে এই সিদ্ধান্ত দিলেন যে, সামনের বছর একটা বিপ্লব হতে যাচ্ছে। মোবারক গদিচ্যুত হবি। কাজেই, সাধু সাবধান!