অনেক ক্ষেত্রে তো আগের পলিথেয়িস্টিক দেব-দেবীই আকিকা করে নতুন নাম নিয়ে থাকলেন। আইরিশদের দেবীর নাম ছিল ব্রিজিদ। আইরিশদের সাথে সাথে এই ব্রিজিদও খ্রিস্টান হলেন। তার নতুন নাম হল সেন্ট ব্রিজিত।
পলিয়থেয়িজম যে কেবল মনোথেয়িজমের জন্মই দিয়েছে, তা নয়।
ডুয়ালিজমের জন্মদাত্রীও সে। ডুয়ালিজম বলে—আমাদের এই প্থিবীটা একটা ব্যাটলফিল্ড। এই রণক্ষেত্রে নিরন্তর যুদ্ধ করে চলেছে দুই কুশীলব। ভাল আর মন্দ। সু আর কু। আল্লাহ আর শয়তান।
আমরা যখন ভাবি—এই দুনিয়ায় এতো অন্যায়-অত্যাচার কেন? কেন মানুষের এতো দুর্দশা? কেন মানুষ মানুষের কল্লা কেটে নেয়? তখন একটা কমন উত্তর আসে—শয়তান মানুষকে দিয়ে এইসব করাইতেসে। তখনই আরেকটা প্রশ্ন আসে। শয়তান তো আল্লাহরই তৈরি। আল্লাহই বা কোন বুদ্ধিতে শয়তানকে তৈরি করলেন?
একেশ্বরবাদ বলে—আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান বুদ্ধি দিসেন। ইচ্ছাশক্তি দিসেন। সেই ইচ্ছাশক্তি কাজে লাগায়া আনুষ ভালো-মন্দ ফারাক করতে পারে। শয়তান না থাকলে তো কোন মন্দ থাকতো না। আর মানুষ ভালো-মন্দ পার্থক্যও করতে পারতো না। ভালো-মন্দ পার্থক্য করার ক্ষমতা আছে দেখেই তো সে ‘মানুষ’—আশরাফুল মাখলুকাত।
এখন কিছু লোক তো মন্দ পথ বেছে নিবেই। সমস্যা হল, ঈশ্বর কী সর্বজ্ঞ নন? তিনি কী ঐ মানুষটার ভূত-ভবিষ্যৎ সব জানেন না? জানলে তো এও জানবেন যে—ঐ লোকটা প্থিবীতে এসে মন্দ কাজ করবে। আর মন্দ কাজের ফলস্বরূপ শাস্তি পাবে। ঈশ্বর যদি আগে থেকেই এতো কিছু জানেন, তাহলে ঐ লোককে আর স্ষ্টি করার দরকার কি? আগে থেকেই তার আত্নাকে দোজখে পুরে দিলে হয়। মোটকথা, একেশ্বরবাদীদের বেশ টাফ টাইম পোহাতে হয় এই প্রশ্নগুলোর কনভিন্সিং উত্তর খুঁজে বের করতে।
ডুয়ালিজমের জন্য ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা সোজা। তারা মনে করে, এই প্থিবীতে দুইটা প্যারালাল গভর্নমেন্ট চলে। একটা ঈশ্বর চালান, আরেকটা শয়তান। ঈশ্বরের অনুপ্রেরণায় ভালো কাজগুলো হয়। আর শয়তানের প্ররোচনায় মন্দ কাজগুলো।
সমস্যা হল, দুইজন দুইজনের প্রতিদ্বন্দ্বী হলে প্থিবীতে যে একটা মিনিমাম লেভেলের কনসিস্টেন্সি আছে—সেটা থাকার কথা না। সেক্ষেত্রে সূর্য একদিন পূর্ব দিকে ওঠার কথা, আরেকদিন পশ্চিমে। কিছুদিন প্থিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরবে, কিছুদিন সূর্য প্থিবীর চারদিকে। কিন্তু এমনটা তো হয় না। F=ma মহাবিশ্বের সর্বত্রই সব সময়ের জন্যই খাটে। স্বাধীন শয়তানের আইডিয়াটাও তাই ঠিক জুৎ করে উঠতে পারে না।
ডুয়ালিজম তাই বলে একদম নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। জরথুস্ত্রবাদের মধ্য দিয়ে এটা আজও প্থিবীতে টিকে আছে। পারস্য থেকে এই ধর্ম ভারতের মুম্বাইতে এসে ঘাঁটি গেড়েছে। বলিউড অভিনেতা ব্যোমান ইরানী থেকে শুরু করে শারমান যোশী ও আরো অনেকেই এই ধর্মের অনুসারী। জরথুস্ত্র বলেন, প্থিবী একটা চিরায়ত যুদ্ধক্ষেত্র যেখানে ভালোর প্রতিষ্ঠার জন্য নিরন্তর লড়ে চলেছেন আহুর মাজদা। শয়তানের বিরুদ্ধে এই লড়াই তিনি একা লড়তে পারেন না। তার প্রয়োজন হয় মানুষের সাহায্য।
ডুয়ালিজমের আরেকটা ভার্শন আছে। এই ভার্শন বলে, ভালো ঈশ্বর আমাদের আত্না দিয়েছেন। আর বদ ঈশ্বর দিয়েছেন দেহ। দেহ তাই খালি আকাম কুকাম করতে চায়। আর আত্না তাকে এইসব থেকে বিরত রাখে। আমরা মানুষেরা আত্না আর শরীরের মধ্যকার এই যুদ্ধের একটা গ্রাউন্ড ছাড়া আর কিছুই না।
মানুষ হবার এই এক জ্বালা। দেহ আর আত্নার এক নিরন্তর গ্হযুদ্ধের নাম আমাদের এই মানব জনম।
০৮. ইতিহাসের নিয়ম
পঁচিশে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী যখন আক্রমণ চালিয়েছিল, তখন কেউ কি ভেবেছিল নয় মাসের মধ্যেই এই জনপদে একটা নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটবে?
পরের বছর দশ জানুয়ারী যখন তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা নিয়ে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসেন, তখন কি কেউ ভেবেছিল সাড়ে তিন বছরের মাথায় এই বাঙালদের হাতেই তাকে মরতে হবে?
কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় হল না বলে যেদিন শাহবাগে জনতার ঢল নামলো, সেদিন কি কেউ ভেবেছিল মাস তিনেকের মাথায় এই ঢাকা শহরেই হেফাজত নামে কেউ এসে দেশের রাজনীতির গতিপথ বদলে দেবে?
ইতিহাসের নিয়মই হচ্ছে এই যে, সে কোন নিয়ম বা ফর্মুলা মেনে চলে না। কিংবা বলা যায়, সে কেবল একটা ফর্মুলাই মেনে চলে। তা হচ্ছে আনপ্রেডিক্টেবিলিটি।
এ কারণেই কোন একটা ঘটনা ঘটে যাবার পর ইতিহাসবিদরা আগের ঘটনার সূত্র ধরে পরের ঘটনা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। যেন প্রথম ঘটনা ঘটেছে বলেই তার রাস্তা ধরে দ্বিতীয় ঘটনার জন্ম হয়েছে। প্রথম ঘটনার সাথে দ্বিতীয় ঘটনা জোর করে লিঙ্ক করার এই যে প্রবণতা—এর নামই হাইন্ডসাইট ফ্যালাসি (Hindsight fallacy)।
এই ফ্যালাসির কারণেই আপনার মনে হবে, পেছনের ঘটনার কারণেই আজকের এই ঘটনাটা ঘটছে। অথচ পেছনের ঘটনা না ঘটলেও হয়তো আজকের এই ঘটনা ঘটতো। আবার পেছনের ঘটনার কারণেই আজ আরো হাজারটা ঘটনা ঘটতে পারতো, যা কিনা ঘটেনি।
ইতিহাসবিদরাও বুঝে না বুঝে হামেশাই এই ফ্যালাসির শিকার হন। চতুর্থ শতাব্দীতে সম্রাট কনস্ট্যানটিন খ্রিস্টধর্মকে রাজধর্ম করে নেন। খ্রিস্টধর্ম কীভাবে রাজধর্ম হল—এই গল্প ইতিহাসবিদরা আমদের বলেন। কিন্তু কেন খ্রিস্টধর্মই রাজধর্ম হল, বৌদ্ধধর্ম বা জরথুস্ত্রবাদ কেন হল না—এই গল্প বলেন না।