খ্রিস্টানদের দুইটা সেক্ট। ক্যাথলিক আর প্রোটেস্ট্যান্ট। দুই দলই বিশ্বাস করে, মরিয়মের ছেলে আমাদের মধ্যে ভালোবাসার বাণী ছড়ায়ে গেসেন। এখন এই ভালোবাসার স্বরূপটা কী—সেটা নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব। প্রোটেস্ট্যান্টরা বিশ্বাস করে, ঈশ্বর স্বয়ং যীশুর বেশে রক্তমাংসে এই প্থিবীতে আসছেন, আমাদের জন্য অত্যাচার সহ্য করসেন, শেষমেশ ক্রুশবিদ্ধ হইসেন। আমাদের যেঁ আদি পাপ ছিল, সেটা উনি নিজ কাঁধে নিয়ে নেওয়ায় আমাদের বেহেশতের দরজা আসলে খুলে গেসে। উনার উপর জাস্ট বিশ্বাস স্থাপন করলেই আমরা তরতর করে বেহেশতে চলে যাব। ক্যাথলিকরাও এই মূল প্রিন্সিপালে বিশ্বাস করে। তবে ওদের একটু সংযোজন আছে। এরা মনে করে, বেহেশতে যেতে হলে আমাদের নিয়মিত চার্চে যেতে হবে আর ভালো কাজ করতে হবে। The Big Bang Theory তে বার্নাডেট যখন বলে, সে ক্যাথলিক স্কুলে পড়সে, সে মিথ্যা কথা বলতে পারে না—ঠিক এই কারণেই পারে না। দুনিয়া যেঁ আখিরাতের শস্যক্ষেত্র —গোঁড়া ক্যাথলিকরা এই ফিলোসফিতে বিশ্বাস করে। প্রোটেস্ট্যান্টরা সেটা করে না।
তাদের কথা হল, ক্যাথলিকরা খোদার সাথে সওদাবাজি করতেসে। ভালো কাজ করলে, আমাকে মান্যিগণ্যি করলে আমাকে প্রমোশন দিবে–এটা অফিসের বসের আচরণ হতে পারে। খোদার না। এতে করে খোদার মহত্বকে খাটো করা হয়। যীশু যে এতো কষ্ট করলো আমাদের জন্য, সেটারও কোন ভ্যালু থাকে না।
এই সামান্য পার্থক্যই ১৬-১৭ শতাব্দীতে হিংস্র রূপ নিলো। ১৫৭২ সালের ২৩শে আগস্ট ফ্রেঞ্চ ক্যাথলিকরা প্রোটেস্ট্যান্টদের উপর নারকীয় হামলা চালায়। ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ১০,০০০ প্রোটেস্ট্যান্টের লাশ পড়ে যায়। রোমানরা ৩০০ বছরেও এতো খ্রিস্টানের লাশ ফেলতে পারে নাই। রোমের পোপ এই খবর শুনে দুঃখ পাওয়া তো দূরে থাক, খুশিতে ফেটে পড়ে বিরাট ভোজ কাম প্রার্থনার আয়োজন করলেন। ভ্যাটিকানের একটা রুমে এই গণহত্যার ফ্রেস্কো করার জন্য এক পেইন্টারও নিয়োগ দিলেন।
ইতিহাস সাক্ষী দেয়, এই সহনশীলতার অভাবেই মনোথেয়িজম থেকে বার বার ‘মুরতাদ’ এর জন্ম হয়েছে, পলিথেয়িজম থেকে হয়নি।
ইনস্টিটিউশনালাইজড একেশ্বরবাদের দেখা আমরা প্রথম পাই মিশরে। যীশুর জন্মের ৩৫০ বছর আগে। সম্রাট আখেনাতেন ঘোষণা দেন যে, আতেন নামের এক দেবতাই সত্যি। আর সব দেব-দেবী মিথ্যা। এক আতেনের পুজাকে তিনি রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন। অন্য সব দেব-দেবীকে মন্দির থেকে দেন খেদায়ে।
তার এই বিপ্লব অবশ্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তার ম্ত্যুর পর পরই বিপথগামী মিশরীয়রা আবার পুরান সব দেব-দেবীকে ফিরায়ে আনে।
মুসা নবী অবশ্য তার আগেই একেশ্বরবাদের প্রচার করে গেছেন। কিন্তু মুসার খোদা ছিলেন একজন লোকাল দেবতা। যার সমস্ত ইন্টারেস্ট ছিল ইহুদী জাতির দেখভাল করা। গোটা মানবজাতির কী হলো, এই নিয়ে তার বিন্দুমাত্র কনসার্ন ছিল না। এরকম লোক আর যাই হোক, ‘ঈশ্বর’ পদের অধিকারী হইতে পারে না।
ব্রেকথ্রুটা আসে যীশুর হাত ধরে। আসলে যীশুর না, সাধু পলের হাত ধরে। শুরুতে খ্রিস্টানরা নিজেদের ইহুদীদের একটা সেক্ট মনে করতো। সাধু পল-ই প্রথম বলেন যে, আমাদের পাপ মোচনের জন্য খোদা স্বয়ং যীশুর রূপ ধরে প্থিবীতে আসছে। ক্রুশবিদ্ধ হইসেন। আমাদের তো উচিত এই গল্প সারা প্থিবীর মানুষের কাছে করা। জন্ম হয় গসপেলের।
সাধু পলের আইডিয়া বিফলে যায়নি। খ্রিস্টান মিশনারীর দল ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। প্থিবীর ইতিহাসে এটা একটা অস্বাভাবিক আর ইউনিক ঘটনা। এর আগে মানুষ যার যার ধর্ম নিয়া সন্তুষ্ট থাকতো। প্রথমবারের মত অন্য জাতির লোকদেরও নিজ ধর্মে টানা শুরু হইলো। তোমার ধর্ম খারাপ আর আমার ধর্ম ভালো, কাজেই তোমার উচিত আমার ধর্ম কবুল করা—এই আইডিয়ার জন্ম হয় তখনই। এর ফলাফলকে যুগান্তকারী বললে কম বলা হবে। কয়েকশো বছরের মধ্যে খ্রিস্টানরা রোমের গদি দখল করে ফেললো।
খ্রিস্টানরা যেটা করসে, ইসলাম সেটা কপি পেস্ট করসে মাত্র। পার্থক্য এইটুকুই— ইসলামের প্রসারটা ছিল আরো তীব্র, আরো ব্যাপক। কেউ ভাবে নাই, যে আরবের একটা ধর্ম দুনিয়ায় এতো প্রভাব বিস্তার করবে। মুসলমানদের তাই শুরু দিকে কেউ অতো পাত্তা দেয় নাই। ভাবসে, দুর্বল একটা সেক্ট হয়েই থাকবে এরা। এই অশিক্ষিত বেদুইনের দল যে গোটা ভূমধ্যসাগরে মাস্তানি শুরু করবে—এটা যে কারো ধারণারও বাইরে ছিল।
পরিবর্তনটা চোখে পড়ার মত। যীশুর জন্মের আগে যেখানে গোটা দুনিয়ায় গুটি কতক একেশ্বরবাদী মানুষ ছিল, সেখানে এক হাজার বছরের মধ্যে হিমালয় থেকে আটলান্টিক একেশ্বরবাদীদের কলরবে মুখর হয়ে উঠলো।
তাই বলে যে একেশ্ববাদের মনোপলি শুরু হয়ে গেলো—ব্যাপারটা অমন নয়। লোকে ঠিকই পুরনো অভ্যাসমত একেশ্বরবাদের খোলসের ভেতর পুরনো পলিথেয়িজমের চর্চা জারি রাখলো।
পলিথেয়িজমের যুগে জুপিটারের কাজ ছিল রোমের দেখভাল করা।মনোথেয়িজমের যুগে এসে আগের অভ্যাসমত নব্য খ্রিস্টানরা নিজেদের রক্ষার জন্য আলাদা আলাদা সাধুর দরবারে মানত করা শুরু করলো। ব্রিটিশরা করলো সেন্ট জর্জের কাছে, স্কটিশরা সেন্ট এ্যান্ড্রু, আর ফরাসীরা সেন্ট মার্টিনের কাছে। এমনকি শহরগুলোরও নিজেদের ভালোমন্দ দেখাশোনার জন্য আলাদা আলাদা পীরের বন্দোবস্ত ছিল। মিলানের ছিল সেন্ট এ্যামব্রোস, ভেনিসের সেন্ট মার্ক। মাথা ব্যথা করলে সেন্ট আগাথিয়াসের কাছে দোয়া করা হত, আর দাঁতের ব্যথায় সেন্ট এ্যাপোলোনিয়ার দরবারে।