এই ভদ্রলোকের নাম মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী।
এইসব ঘটনা অবশ্য সাম্রাজ্যের শুরুর দিকে ঘটে। সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব যতো বাড়তে থাকে, সে সাম্রাজ্যের কোর জনগোষ্ঠীর বাইরের মানুষদেরও পলিসি মেকিং লেভেল ওয়েলকাম করা শুরু করে। হাতের কাছেই সবচেয়ে বড় উদাহরণ বারাক ওবামা। ১০০ বছর আগে হলে কেনিয়ার রক্ত গায়ে থাকা কোন লোকের ইউএস প্রেসিডেন্ট হবার স্বপ্ন বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই ভাবা হত না। সিরিয়া আর লিবিয়ার লোক এসে এক সময় রোমের তখতে বসে গেছে। ইসলামের মুকুট আরবদের হাত থেকে চলে গেছে টার্কিশদের হাতে।
সাম্রাজ্যের এ এক অবশ্যম্ভাবী জীবনচক্র। বিশুদ্ধ চাকুরী বলে যেম ন কিছু নেই, বিশুদ্ধ সাম্রাজ্য বলেও কিছু নেই। আজ আপনি যাকে পদানত করছেন, সে কিংবা তার সন্তান ঐ একই প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে একদিন আপনাকে পায়ের নিচে ফেলবে।
সান্ত্বনা এইটুকুই যে, ঐ প্লাটফর্মটা পুরাতন সাম্রাজ্যবাদীদেরই তৈরি করা।
আমরা চায়ের কাপে ঝড় তুলে ব্রিটিশদের যতোই গালিগালাজ করি না, এই চায়ের অভাসটাও কিন্তু ব্রিটিশদেরই দান। কিংবা যে ক্রিকেট নিয়ে আমাদেরে তো মাতামাতি, যে একটা ইস্যুতে আমরা সবাই একমত হই—সেই ক্রিকেটটাও ব্রিটিশরাই আমাদের শিখিয়ে গেছে। সাম্রাজ্যবাদ খেদাও বললেই আমরা চোখ বুঁজে এর সব কিছু খেদাতে পারি না।
আমাদের নিজেদের অস্তিত্বের লুঙ্গিতেই টান পড়বে তখন।
গ্রীক দেব-দেবী বলতে সবাই জিউস, হেরা, এ্যাপোলো—এদের নাম জানি। যেটা জানি না, সেটা হল এদের সবার মাথার উপরে একজন ছিল যাকে এরাও সমঝে চলতো। ইনার নাম আনাখ বা ভাগ্য। প্রায় সকল পলিথেয়িস্টিক ধর্মেই এমন একজন সুপ্রীম সত্তার সন্ধান পাওয়া যায়। পলিথেয়িস্টিক হয়েও এরা তাই বিশুদ্ধ পলিথেয়িস্টিক নয়। এক আর বহু—দু রকম ঈশ্বরে বিশ্বাসই এখানে জড়াজড়ি করে অবস্থান করে।
চাইলে অজস্র উদাহরণ দেয়া যাবে। পশ্চিম আফ্রিকায় ইয়োরুবা নামে একটা ধর্ম আছে। যার বিশ্বাস মতে, সকল দেব-দেবতার জন্ম Olodumare নামের এক সুপ্রীম দেবতার ঔরসে। সবচেয়ে জনপ্রিয় বহু ঈশ্বরবাদী ধর্ম হিন্দু ধর্মেও ‘পরমাত্না’ নামক এক মহান সত্তার কথা বলা হয়েছে, যে কিনা সমস্ত মানুষ, জীব-জানোয়ার আর অতি অবশ্যই দেব-দেবীদেরও নিয়ন্ত্রণ করে।
পলিথেয়িজমের ঈশ্বরের সাথে ট্রাডিশনাল মনোথেয়িজমের ঈশ্বরের পার্থক্য হচ্ছে—পলিথেয়িজমের ঈশ্বর মানুষের দৈনিক মামলায় নাক গলান না। কার ক্যান্সার হইলো, যুদ্ধে কে মরলো কে বাঁচলো, কে পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে ছায়—এগুলা তার কনসার্নের বিষয় না। মানুষও চালাক। গ্রীকরা তাই আনাখের উদ্দেশ্যে কিছু বলি দিত না কিংবা হিন্দুরাও আত্নার সম্মানে কোন মন্দির বানায় না।
পরম ঈশ্বরের সাথে একমাত্র দেন দরবার হতে পারে যদি তুমি নির্বাণ চাও। হিন্দু সাধুরা যেটা করে। তারা একটা বার্ডস আই ভিউ থেকে জগৎটাকে দেখার অভ্যাস রপ্ত করে। একবার এই অভ্যাস হয়ে গেলে জগতের দুঃখ-দারিদ্র্য, জরা কোন কিছুই তাদের স্পর্শ করে না। তারা এগুলাকে স্বাভাবিক আর ক্ষণস্থায়ী ন্যারেটিভ মেনে নিয়ে পরম ঈশ্বর যেমন এ সব কিছুর প্রতি উদাসীন, তারাও এই উদাসীন এ্যাটিটুডটা গেইন করে।
সাধুরা না হয় বউ-বাচ্চা ছেড়ে দিয়ে পরম ঈশ্বরের সন্ধান পাইলো। আমাদের মত ছাপোষা মানুষের কী হবে? আমরা তো পরম ঈশ্বরের ঐ লেভেলে পৌঁছাতে পারতেসি না। আমাদের ১৪০০ স্কয়ার ফিটের বাসা বা সিভিক হোন্ডার চাহিদা তো ঐ পরম ঈশ্বর মেটাবে না। তো আমাদের জন্য ব্যবস্থা হচ্ছে স্পেশালাইজড ক্ষমতা সম্পন্ন ইন্টারমেডিয়েট দেব-দেবী। লক্ষ্মী আমদের ফ্ল্যাট দিবে, সরস্বতী ডিগ্রি।
বহু ঈশ্বর কিন্তু এক সেন্সে এক ঈশ্বরের চেয়ে ভালো। যে লোক এক ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, সে তার বিশ্বাসের কারণেই গোড়া হতে বাধ্য। অন্য ধর্মের দেব-দেবীকে তার ধর্মে কনটেইন করার জায়গা তার নেই। বহু ঈশ্বরবাদীদের এই সমস্যা নাই। এরা অনেক বেশি ওপেন, অনেক বেশি লিবারেল। তার ধর্মে ফ্ল্যাটের দেবী আছে, ডিগ্রির দেবী আছে, কিন্তু ফুটবলের দেবী নাই। এখন অন্য কোন কালচার যদি তার ধর্মে ফুটবলের দেবী আমদানি করে, সে তাতে খুব একটা আপত্তি করবে না। উলটা ওয়েলকাম করবে।
রোমানরা যেমন গ্রীকদের সব দেব-দেবীকে নিজেদের করে নিসে। গ্রীক জিউস রোমে এসে হয়ে গেছে জুপিটার, এরোস হয়ে গেছে কিউপিড আর আফ্রোদিতি, ভেনাস। রোমানরা এই ব্যাপারে এতোটাই উদার ছিল যেঁ এশিয়ান দেবী সিবিল আর মিশরীয় দেবী আইসিসকেও এরা এদের মন্দিরে স্থান দিতে দ্বিধা করেনি।
একমাত্র যে দেবতার সাথে এদের খটোমতো লাগসিলো—সেটা হল খ্রিস্টানদের দেবতা। গড। আল্লাহ। ইয়াওয়েহ। রোমানরা চাচ্ছিলো< খ্রিস্টানরা যেন তাদের আল্লাহর পাশাপাশি জুপিটার আর বেনাসেরও পুজা করে। এটা
খালি ধর্মীয় লয়্যালটির প্রশ্ন না, রাজনৈতিক রয়্যালটিরও প্রশ্ন।
খ্রিস্টানরা তো কোনভাবেই এক আল্লাহ ছাড়া আর কারও সামনে মাথা নত করবে না। এটাকে যতোটা না ধর্মের বিরুদ্ধে, তার চেয়ে বেশি সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসেবে দেখা হইলো। ফলাফল, যীশুর ম্ত্যুর ৩০০ বছরের মধ্যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে কয়েক হাজার খ্রিস্টানের ম্ত্যু। মজার ব্যাপার হল, এর পরের ১৫০০ বছর খ্রিস্টানরা নিজেরাই নিজেদের ইচ্চছেমত কচুকাটা করসে। তাও, খুব সিলি একতা ব্যাপার নিয়ে।