যে লোক The siege of Numantia লিখে সে জাতীয় বীরদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে প্থিবীর মানুষের লাছে, তার লেখার স্টাইলও সে কিন্তু পেয়েছে রোমান লেখকদের কাছ থেকেই। চার্চে যখন এই বীরদের জন্য দোয়া করা হয়, সেই দোয়ার ভাষাও কিন্তু আসছে এই রোমান ক্যাথলিক চার্চ থেকেই। স্প্যানিশ খাবার-দাবার বলেন, আইন-কানুন বলেন, আর্কিটেকচার বলেন—সবকিছুতেই হানাদার রোমানদের ছাপ স্পষ্ট।
যে নুম্যানশিয়াকে স্পেনের স্বাধীনতা চেতনার সিম্বল ভাবা হয়, সেই চেতনার ছাইটুকুও আজ তাদের মধ্যে নেই। সবটুকু রোমান সাম্রাজ্যবাদের পেটে ঢুকে অড়েছে।
এইখানেই সাম্রাজ্যবাদের জয়। এর পতন আছে, কিন্তু বিনাশ নেই। পতন তো ঘটবেই। রোমানদের ঘটেছে, অটোম্যানদের ঘটেছে, আমেরিকাও একদিন ফল করবে। কিন্তু মরে যাবার আগে এরা একটা স্থায়ী ছাপ রেখে যায়। এদের বেঁধে দেয়া জীবনযাত্রায় বসবাস করে, স্বপ্ন দেখে আরেক সভ্যতার মানুষ।
এই কাজটা ব্রটিশরা করেছে ভারতবর্ষের সাথে। চাকরির লোভ দেখিয়ে গোটা ক্ষিভিত্তিক ভারতের খোলনলচে দিয়েছে পালটে। পাখি চলে গেছে, পালকখান রয়ে গেছে। ব্রিটিশ চলে গেছে, প্যান্ট-স্কার্ট রেখে গেছে। ঠিক এই কাজটাই একটু অন্যভাবে ভারত করছে তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে। মুম্বাইয়ের অল্প কিছু মানুষ বসে ঠিক করে দিচ্ছে—আমার আপনার বিয়ের প্রোগ্রামটি কেমন হবে। এর স্টেজ সাজানো, গান বাজানো থেকে শুরু করে বর-কনের পোশাক পর্যন্ত ঠিক করে দিচ্ছে মুম্বাই মুমিনেরা।
আধুনিক নেশন স্টেটের যুগে এসেও তাই সাম্রাজ্যবাদের ফজিলতে অস্বীকার করার কোন উপায়ই আমাদের হাতে নেই।
মানুষ স্বভাবতই জেনোফোবিক। নিজ গোত্রের লোক ছাড়া বাইরের কাউকে সে দেখতে পারে না। কিংবা দেখলেও সন্দেহের চোখে দেখে।
ঢাকার রাস্তায় যদি হঠাৎ করে আফ্রিকানের সংখ্যা বেড়ে যায়, আপনার মনে খুঁতখুঁত করবে। এতো আফ্রিকান আইলো কোইথ থেইকা? ঠিক যে কারণে ফ্রান্স মুসলিমদের দেখতে পারে না। মুসলিমদের সে কখনোই ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারে না। ঠিক এই কারণেই অফিসের বস বরিশালের হলে সেই অফিস কিছুদিনের মধ্যেই বরিশালের লোকজনে গমগম করে। আইইউটি’র হলে আইউইটিয়ানদের কিচির মিচিরে।
আপনি এটাকে অঞ্চলপ্রীতি বা স্বজনপ্রীতি বলবেন। সত্যিটা হচ্ছে এই যে, বরিশাল বা আইইউটি’র ঐ বসের কোন দোষ নেই। মানুষ মাত্রই কমফোর্ট জোনে থাকতে চায়। সে তার ফেলো বরিশালিয়ান বা আইইউটিয়ানদের পাশে ঐ কমফোর্ট জোনটা পায়। অন্য অঞ্চল বা প্রতিষ্ঠানের লোকের উপর সে ততোটা খবরদারি খাটে পারে না যেটা পারে নিজ অঞ্চল বা প্রতিষ্ঠানের ছেলেপিলের উপর। আমাদের ডিএন’এ’র গভীরে যে আমরা ভার্সেস তোমরা বলে একটা ব্যাপার আছে, সেই ভূগোলের আমরা অংশে পড়ে তার আপন এলাকার লোকজন। এর বাইরের প্থিবী তার কনসার্নের মধ্যে পড়ে না।
ইন ফ্যাক্ট, নিজ গোত্রের বাইরের মানুষকে আমরা মানুষের কাতারেই ফেলি না। আমাদের প্রাথমিক ভাষাগুলোতে এর অজস্র প্রমাণ রয়েছে। সুদানে Dinka নামে একটা গোষ্ঠী আছে। ওদের ভাষায় Dinka মানে মানুষ। তার মানে এর বাইরের কেউই মানুষের সংজ্ঞায় পড়ে না। Dinka দের চিরশত্রু হচ্ছে Nuer জনগোষ্ঠী। নয়ারেদের ভাষায় আবার Nuer মানে হচ্ছে আসল মানুষ। সুদানী সভ্যতা থেকে বহু দূরে আলাস্কায় ইয়াবাক জনগোষ্ঠীর বাস। গেস হোয়াট? ইয়াবাক শব্দের অর্থও হচ্ছে প্রক্ত মানুষ।
এই পর্যায়ের জেনোফোবিক মানুষ কীভাবে সাম্রাজ্যের জন্ম দিল—সেটা একটা রহস্য বটে। সাম্রাজ্য ঠিকঠাক ফাংশন করার জন্য যে পরিমাণ সহনশীলতার প্রয়োজন, সহযোগিতার প্রয়োজন মানুষের মধ্যে তো ব্যাসিক্যালী সেটা নাই। সাম্রাজ্য তাহলে চলে কীভাবে?
খুব সিম্পল। অন্যায় আর রক্তপাতের মধ্য দিয়ে।
আমেরিকা যখন ইরাক বা আফগানিস্তান আকরমণ করে, তখন নিজেদের কাজকর্মকে জাস্টিফাই করে এই বলে যে—তোমাদের ভালর জন্যই আমরা এটা করতেসি। হাসপাতালে বোমা পড়ছে, শিশুরা এতিম হচ্ছে, মানুষজন ঘরছাড়া হচ্ছে—এগুলো সব স্থূল দর্শন। বর্তমানের এই ঘোলাটে কাচ পরিষ্কার করে তোমরা যদি একটু দূরে তাকাও, দেখবা আজকের এই কষ্টের বিনিময়ে দিন শেষে তোমাদের জন্য ভালোই আছে।
‘তোমাদের ভালোর জন্যই করতেসি’—শাসকদের স্ক্রিপ্টে এটা কোন নতুন কথা না। রোমানরা মনে করতো, তাদের সভ্যতাই সেরা। যারা এই সভ্যতার স্বাদ পায়নি, তারা অন্ধকারে আছে। এদের অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসার জন্য হলেও রোমান শাসনের অধীনে আনা জরুরী। সেটা যদি ফরাসী বা জার্মান নারীদের বিধবা করে হয়—তবুও। বরং যারা বেঁচে আছে, তাদেরকে রোমান শিক্ষা, সংস্ক্তির ছোঁয়ায় এনে এদের প্রতি এক প্রকার এহসান করতেসে বলেই এদের মনে হত।
নিজ সভ্যতাকে সে ছড়িয়ে দেয় বটে। পরাধীন জনগোষ্ঠীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সভ্যতাকে দৈনিক ব্রাঞ্চের সাথে হজম করে ফেলে সে। আবার পরাধীন জনগোষ্ঠীর কেউ যদি সেই সভ্যতায় সুসভ্য হয়ে ওঠে, তাকে সে সার্টিফিকেট দিতেও তার চরম অনীহা।
এক ভারতীয় ভদ্রলোকের গল্প বলি। ঊনিশ শতকের শেষ দিক তখন। ভদ্রলোক ইংরেজিদের মতই ফটাফট ইংরেজি বলতেন, তাদের মতই নাচতে জানতেন, ছুরি-কাঁচি দিয়ে খেতে পারতেন বেশ। লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করা এই ভদ্রলোক আরেক ব্রিটিশ উপনিবেশ দক্ষিণ আফ্রিকায় এলেন প্র্যাকটিস করতে। স্যুট-টাইয়ের গরমে চড়ে বসলেন ট্রেনের প্রথম শ্রেণির কামরায়। খালি স্যুট-টাই পরলেই তো হবে না, গায়ের রং-টাও তো ফর্সা হতে হবে। তার মত কালোদের জন্য বরাদ্দ ছিল থার্ড ক্লাশের কামরা। ফলাফল, নিয়ম ভাঙার দায়ে তাকে ফার্স্ট ক্লাস থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হয়।