তবে টাকা জাল করে বড়লোক হতে চাইলে আমি একটা ছোট্ট সাজেশান দিতে পারি। কখনোই বাজারে বড় নোট ছাড়বেন না। বড় নোট সবাই চেক করে। পাঁচশো বা এক হাজার টাকার নোট জাল করে ধরা খাওয়া চান্স তাই অনেক বেশি। জাল করবেন একশো বা পঞ্চাশ টাকার নোট। ধরা খাওয়া চান্স ৯৯% যাবে।
যা বলছিলাম, লোকে আসলে টাকায় বিশ্বাস করে না। টাকাটা যেই লোক বা অথরিটি ইস্যু করসে, বিশ্বাসটা আসলে তার উপর। আমেরিকান ডলারে আমাদের বিশ্বাস বাংলাদেশি টাকার চেয়ে বেশি কেন? কারণ, আমেরিকান সিস্টেমের উপর আমাদের বিশ্বাস। এখানকার স্ট্রাকচার আর সিকিউরিটির উপর বিশ্বাস। আমাদের এলিট সমাজ কেন বাংলাদেশে ইনভেস্ট না করে মালয়েশিয়ায় বাড়ি বানায়? কারণ সে জানে এখানকার টাকার কোণ ভ্যালু নাই। আজ সরকার বদল হলে ব্যাঙ্কে তার হাজার কোটি টাকার কানাকড়িও ভ্যালু থাকবে না। বাধ্য হয়ে সে তাই টাকা সরিয়ে মালয়েশিয়া/সিঙ্গাপুর রাখে। যেখানে তার টাকার আজকে যেই ভ্যালু, কালকেও সেই একই ভ্যালু থাকবে।
এইজন্যই রোমান দিনারিয়াস কয়েনের এতো ভ্যালু ছিল পুরো আফ্রো-এশিয়ায়। রোমান সম্রাটের উপর বিশ্বাস এতোই প্রবল ছিল যে ভারতে পর্যন্ত এই দিনারিয়াসে কেনাবেচা হত হামেশাই। আরব মুদ্রার নাম যে দিনার, সেও এসেছে এই ‘দিনারিয়াস’ থেকেই।
আর টাকার সর্বগ্রাসী ক্ষমতার কথা কে না জানে? যে আরব মুসলিম বিশ্বাস করে, যীশু আল্লাহর নবী, সন্তান নয়, তার কাছেও যদি প্রবল পরাক্রমশালী কোন মুদ্রা আসে, যার উপর লেখা—যীশু আল্লাহর সন্তান—সে খুশিমনে সেই মুদ্রা ব্যবহার করবে। তার ধর্মের অপমান হয়েছে বলে এই মুদ্রা সে বর্জন করবে না।
টাকার সাফল্য যদি কিছু থেকে থাকে—এটাই। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সম্পূর্ণ অপরিচিত দুইটা মানুষের মধ্যে বিশ্বাস স্থাপন করা। আমাদের বিশ্বাসের যদি কোন স্তম্ভ তৈরি হয়ে থাকে, সেই স্তম্ভের সবচেয়ে উঁচু আসনটায় থাকবে এই টাকা।
০৭. সাম্রাজ্যবাদের রূপ
যে ফার্মাসিস্ট ছেলেটা দিনরাত সালমান এফ রহমানকে গালি দিত শেয়ারবাজার লুটেপুটে নেবার জন্য, পাশ করে সেই হয়তো বেক্সিমকোতে জব করে। হাজার কোটি টাকা ট্যাক্স ফাঁকি দেয় বলে গ্রামীণফোনকে যে মেয়েটা দুই চোখে দেখতে পারতো না, সেই ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে জিপিহাউসে ইন্টারভিউ দিতে আসে। যে বামপন্থী ছেলেটা আমেরিকাকে দুনিয়ার সব সমস্যার মূল মনে করে, সেও অনার্স পাশ করেই জিয়ারই পরীক্ষার ডেট খোঁজে। কাপলান, প্রিন্সটনে বোঝাই হয় তার পড়ার টেবিল।
সালমান এফ রহমান, গ্রামীনফোন কিংবা আমেরিকা—প্রত্যেকেই সাম্রাজ্যবাদের এক একটা রূপ। আমরা সাধারণ মানুষেরা উঠতে বসতে এই সাম্রাজ্যবাদীদের গালি দিই। আবার সাম্রাজ্যবাদের ছায়াতলে না থাকলে আমাদের চলেও না। আমরা সিকিউরড ফীল করি না। মধ্যবিত্তের এ এক নিদারুণ ক্রাইসিস।
আমাদের জন্যে যেটা মানসিক ক্রাইসিস, সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য সেটাই এক ধরনের খেলা। মজার খেলা। তারা জানে, সবাই তাদের ঘ্ণা করে। আবার এও জানে, দিন শেষে একে একে সবাই তার নৌকাতেই উঠবে।
আমাদের অতি অতি পূর্বপুরুষেরা তাই জাহাজে করে ভূমধ্যসাগরে গেছে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে। রোমের বাজারে জিনিস বেচতে। রামমোহন-রবীন্দ্রনাথেরা বিলেতে গেছেন ডিগ্রি আনতে। আর আমরা যাচ্ছি কানাডা-আমেরিকায়।
শুরু শুরুতে যে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রেজিস্ট্যান্স আসে না–তা না। ভালো রকমের প্রতিরোধ আসে। যেমন প্রতিরোধের দেয়াল গড়েছিলে স্পেনের পাহাড়ি শহর নুম্যানশিয়ার অধিবাসীরা। অপ্রতিরোধ্য রোমান বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের সম্বল বলতে ছিল কেবল মাত্ভূমির প্রতি ভালোবাসা।
রোমরা লেজিয়নের পর লেজিয়ন পাঠাচ্ছিল বেয়ারা স্প্যানিশদের শায়েস্তা করতে। আর হেরে ফেরত আসছিলো। সাম্রাজ্যের নিয়মই হচ্ছে, সে ছোট ছোট ব্যাটল হারবে। কিন্তু আল্টিমেট যুদ্ধ ঠিকই জিতে নিবে। রোমানদের ধৈর্যের বাঁধ এবার ভেঙে গেল। তারা জেনারেল স্কিপিওর নেত্ত্বে ৩০,০০০ সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী পাঠালো। এই সে স্কিপিও যিনি রোমের ঠিক আগের সাম্রাজ্য কার্থেজকে একেবারে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিলেন।
স্কিপিও ছোট ছোট গেরিলা যুদ্ধে সময় আর সৈন্য নষ্ট না করে পুরো শহরকে এই বিরাট সৈণ্যদল দিয়ে ঘিরে ধরার প্ল্যান করলেন। বাইরের প্থিবীর সাথে নুম্যানশিয়ার সমস্ত সংযোগ কেটে দিলেন। এক বছরের মাথায় ভেতরের অধিবাসীদের খাদ্যেয় সাপ্লাই ফুরিয়ে গেলো। তাদের বোধোদয় হল, হোপ ইজ এ্যা গুড থিং। কিন্তু এই মুহূর্তে তাদের আর কোণ আশা নাই। তারা পুরো শহরটাকে জ্বালিয়ে দিল। নিজেরাও আত্নহত্যা করলো, যেন রোমান দাস হয়ে অন্তত জীবন কাটাতে না হয়।
নুম্যানশিয়া পরে স্প্যানিশ স্বাধীণতার প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কবিরা এই নিয়ে কবিতা লিখেছেন, লেখকেরা গল্প-উপন্যাস। এইখানে স্ম্তিসৌধ হয়েছে। প্রতি বছর দেশপ্রেমী স্প্যানিশেরা এইখানে তাদের সাহসী পূর্বপিউরুষদের স্মরণ করতে আসেন।
এই গল্পটা বললাম—তার একটা কারণ আছে। যে স্প্যানিশ ভাষায় গান-কবিতা লেখা হচ্ছে জাতীয় বীরদের স্মরণে, এই স্প্যানিশ কিন্তু দখলদার রোমানদের ভাষা ল্যাতিন-এরই সন্তান। নুম্যানশিয়া তথা স্পেনের অধিবাসীদের আদি ভাষা কিন্তু স্প্যানিশ না। এরা যে ভাষায় কথা বলতো, সেটা আজ ম্ত।