যাই হোক, এরপর কী ঘটে? নিয়েন্ডারথালরা কি এই আগন্তুকদের সাদরে বরণ করে নেয় না বহিরাগত বলে যুদ্ধ ঘোষণা করে?
ফ্র্যাংক্লি, এর উত্তর আমরা জানি না।
তবে পরবর্তী ঘটনা ব্যাখ্যা করার জন্য দুটো হাইপোথেসিস আছে। একদল বলেন, সেপিয়েন্সরা আর নিয়েন্ডারথালরা একে অপরকে ভালবেসে সুখে-শান্তিতে বংশব্দ্ধি করিতে লাগিলো। আজকে আমরা যে লালমুখো ইউরোপিয়ানদের দেখি, তারা এই সেপিয়েন্স আর নিয়েন্ডারথালদের ভালবাসারই ফসল।
সেপিইয়েন্সরা যে খালি ইউরোপেই ভালবাসার বার্তা নিয়ে গেছে, তা কিন্তু নয়। এরা ছড়িয়ে পড়েছিল এশিয়ার পূর্বভাগেও। আজ আমরা যে চাইনিজ, কোরিয়ানদের দেখি তারা সেপিয়েন্স আর ঐ অঞ্চলে আগে থেকেই বসবাসরত হোমো ইরেক্টাসদের ভালবাসাবাসির ফল।
এটা যথেষ্ট অপ্টিমিস্ট থিওরি। এর বিপরীত থিওরিও আছে। এই থিওরী বলে, নিয়েন্ডারথাল রোমিও আর সেপিয়েন্স জুলিয়া যদি একে অপরের প্রেমে পড়েও, তাদের জেনেটিক দূরত্ব এতোই বেশি যে তাদের দ্বারা সন্তান উৎপাদন সম্ভব নয়। এই কারণেই হোক কিংবা অন্য কোন কারণেই হোক, দুই দলের মধ্যে এক রকম বৈরীভাব দেখা দিল। তার ফলস্বরূপ যুদ্ধ। যে যুদ্ধের মেয়াদ শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করার আগ পর্যন্ত জারি থাকে।
মজার ব্যাপার হল, টেকনোলজিক্যালী নিয়েন্ডারথালরা এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও এই অস্তিত্বের যুদ্ধে তারা সেপিয়েন্সদের কাছে হেরে গেলো। এরপর থেকে ৭০ হাজার বছর ধরে সেপিয়েন্সরাই মানুষের ট্যাগ নিয়ে প্থিবী দাপিয়ে বেড়াতে লাগলো।
এই প্যাটার্ণটা প্থিবীর অন্য জায়গাতেও লক্ষ করা যায়। হোমো সেপিয়েন্সরা যেখানেই পৌঁছেছে, সেখানেই অন্য প্রজাতির মানুষেরা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন এটা গণহত্যার কারণে হয়েছে না কোন অন্য কোন কারণে হয়েছে—সেটা গবেষণার বিষয়। ইউরোপীয়রা যেমন আমেরিকান রেড ইন্ডিয়ানদের কেবল কামান দেগেই হত্যা করেনি, ইউরোপীয়রা নিজেদের শরীরে যে রোগবালাই’র জীবাণু সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল, রেড ইন্ডিয়ানদের মধ্যে সেইসব জীবাণুর বিরুদ্ধে কোন রকম প্রতিরোধ ক্ষমতা না থাকাতেও এরা কাতারে কাতারে মরেছে। নিয়েন্ডারথাল আর হোমো ইরেক্টাসদের ক্ষেত্রেও এমন কিছু ঘটা বিচত্র নয়।
তবে যদি গণহত্যা থিওরী সত্যি হয়ে থাকে, তবে বলতে হয়—ইতিহাসের প্রথম গণহত্যার নায়ক চেঙ্গিস খান বা হালাকু খান নয়, নায়ক আমরা এই হোমো সেপিয়েন্সরা। যার জন্য আমাদের আজও কোন কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি। আমাদের মধ্যে যে হিংস্র, খুনে মানসিকতা বসত গেড়ে আছে, তা মধ্যযুগ বা কোন আধুনিক অস্ত্রের দান নয়। সত্তর হাজার বছর ধরে এই খুনে উল্লাস আমাদের ধমনীতে বয়ে চলেছে। শিক্ষা, সংস্ক্তি, ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় ভয়ভীতি দিয়ে আমরা সেই খুনে সত্তাকে ঢেকে রাখি মাত্র।
একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। নিয়েন্ডারথালরা যদি হোমো সেপিয়েন্সদের তুলনায় টেকনোলজিক্যালী এগিয়েই থাকে, তবে ওরা কেন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল? নিশ্চিহ্ন তো হয়ে যাবার কথা আমাদের। প্থিবীর ইতিহাস তো তাই বলে। এই প্রশ্নের উত্তর না হয় আরেকদিন দেব (যদি আদৌ লেখা হয় আর কি।)
আগের দিন বলেছিলাম, নিয়েন্ডারথাল মানুষেরা হোমো সেপিয়েন্স মানুষদের চেয়ে শারীরিক শক্তিতে এগিয়ে আর টেকনোলজিক্যালী সমানে সমান থাকার পরও তারা এই সেপিয়েন্সদের হাতেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কিন্তু কেনো? আজ সেই গল্পটাই বলবো।
নিয়েন্ডারথালদের সাথে সেপিয়েন্সদের প্রথম মোলাকাত হয় এক লক্ষ বছর আগে। মজার ব্যাপার হল, সেই মোলাকাত সেপিয়েন্সদের জন্য কোন সুখবর বয়ে আনেনি। উলটো নিয়েন্ডারথালদের দাপটে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। নিয়েন্ডারথালরা তাদের ভূমিতে, এখনকার মধ্যপ্রাচ্যে বউ-বাচ্চা নিয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে থাকে।
এরপর কেটে গেলো তিরিশ হাজার বছর। আজ থেকে সত্তর হাজার বছর আগে সেপিয়েন্সরা তাদের দ্বিতীয় এ্যাটেম্পট নেয়। আবারও দলবল নিয়ে আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে পড়ে। অল্প সময়ের মধ্যেই এরা ইউরোপ আর এশিয়ার পূর্বভাগ দখল করে নেয়। নিয়েন্ডারথাল থেকে শুরু করে হোমো ইরেক্টাস—যতো রকম মানুষ ছিল, সবাইকে প্রথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। ৪৫ হাজার বছর আগে এদের একটা দল প্রথমবারের মত অস্ট্রেলিয়ায় পা রাখে। এই সময়কালেই এরা ডিজাইন করে নৌকা, তীর-ধনুক আর সুইয়ের মত চমৎকার সব যন্ত্রপাতি।
কথা হল—হঠাৎ করে মানুষের বুদ্ধি এতো বেড়ে গেলো কীভাবে?
হিস্ট্রি চ্যানেলের যে কোন প্রোগ্রামে দেখবেন, এই ব্যাপারটাকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ভিনগ্রহীদের আগমন দ্বারা। মিশরের পিরামিড থেকে শুরু করে পেরুর নাজকা লাইন পর্যন্ত সবকিছুই এই ভিনগ্রহীদের দান। তো এই ভিনগ্রহীরা এসে এইখানে বিয়েশাদি করছে। যেহেতু তারা আমাদের চেয়ে উন্নততর মগজের অধিকারী ছিল, সন্তান হিসেবে তাদের মগজের কিছু অংশ আমরা পেয়ে গেছি। কাজেই, আমরা হঠাৎ করে এতো বুদ্ধিমান হয়ে উঠেছি।
যে কোন ধর্মেই পুরাণে দেখবেন, দেবতার সাথে মানুষের বিয়ে হওয়ার একটা বেশ রেওয়াজ চালু ছিল। ধর্ম বলেন, রাষ্ট্র বলেন-সব জায়গাতেই দেবতার ঔরসজাত না হলে আপনি পাত্তাই পাবেন না—এমন অবস্থা। অনেক ক্ষেত্রে বিয়েতে রাজি না হলে দেবতাটি ছলে-বলে-কৌশলে শারীরিক সম্পর্ক আদায় করে নিতেন। জিউস যেমন। এখন কথা হচ্ছে, ভিনগ্রহীরা যদি সত্যিই এসে থাকে, তবে পুরাণে বর্ণিত এই দেবতারাই সেই ভিনগ্রহী নয় তো?