খালি কনভার্টিবল হলেই হবে না। এর আরো দুটো গুণ থাকা লাগবে। এক, একে সহজে স্টোর করা যাবে। আর দুই, একে সহজে ট্রান্সপোর্ট করা যাবে। শস্যকে টাকা হিসেবে ব্যবহার করলে দুটো সমস্যাই হয়। একে তো একে স্টোর করলে হয় ইঁদুরে খেয়ে ফেলবে নয়তো গুদামে আগুন লেগে যাবে। আর এটা সহজে পরিবহণযোগ্যও না। ধরা যাক, আপনি বাড়ি বিক্রি করবেন। এখন বাড়ি বিক্রির বিনিময় হিসেবে কি কয়েক মণ ধান বা লবণ নিয়ে দুই ক্রোশ পথ পাড়ি দবেন? পেইনটা একটু বেশিই হয়ে গেলো না?
কয়েন আর নোট্রূপী টাকা এসে এই সব সমস্যার সমাধান করেছে। নিজের কাছে রাখতে ভয় পাচ্ছেন? অকা। বাড়ির কাছে ব্যাঙ্কে গিয়ে রেখে আসেন। টাকা নিয়ে দুই ক্রোশ দূরে যাওয়া দরকার? আপনাকে গরুর গাড়ি বোঝাই করে টাকা নেয়া লাগবে না। লুংগির গিঁটে বেঁধে নিলেই চলবে।
গুণীজনেরা তাই টাকাকে সকল সমস্যার মূল বললেও টাকাই আবার সকল সমস্যার সমাধানও।
আগেই বলেছিলাম, মানুষের গল্প করতে গেলে মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের বার বার ফিরে আসতেই হবে। এখন যেমন আমরা আছি সুমেরীয়ানদের সাথে সুমেরে। আজকের ইরাকের দক্ষিণ প্রান্তে।
টাকার গল্পটাও এইখান থেকেই শুরু। যীশুর জন্মেরও তিন হাজার বছর আগে এখানেই প্রথম বার্লির দানাকে টাকা হিসেবে চালিয়ে দেয়া হয়।
এই দানা দিয়েই সমস্ত কিছু কেনাবেচা করা হত। বার্লির দানা ঠিকঠাক ওজন করা জন্য প্রায় এক লিটারের একটা স্ট্যান্ডার্ডাইজড বাটি তৈরি করা হল। স্যালারি দেয়া হত এই বাটিতে বার্লি ওজন করে।
এক লিটারের এই স্ট্যান্ডার্ডাইজড বাটিকে বলা হত এক সিলা। একজন পুরুষ শ্রমিক হয়তো মাসে ষাট সিলা কামাতে পারতো। নারী শ্রমিক কামাতো ত্রিশ সিলার মত। এদের যে ফরম্যান ছিল তার কামাই ছিল মাসে ১২০০-৫০০০ সিলার মত। ৫০০০ সিলা বার্লি খেয়ে নিশ্চয়ই সে শেষ করতে পারতো না। যেটুকু বেঁচে যেত, সেটা সে পরিবারের জন্য মাছ, মাংস, দুধ-ডিম কিনতো।
শুরু শুরুতে মানুষকে কনভিন্স করা আসলেই টাফ ছিল—যে তোমার বার্লি খালি বার্লি না, এটা হল টাকা। আপনি যদি এই ইতিহাসে অনুপ্রাণিত হয়ে বাসার চালের বস্তাটা পিজা হাটে নিয়া পিজা কিনতে চান, পিজা হাটের লোক হয় আপনাকে পাগল ভাববে নয়তো পুলিশ ডাকবে। সেই সময় তো কাগুজে টাকার ধারণা ছিল না। আর বার্লি যেহেতু খাওয়া যায়, এর একটা নিজস্ব ভ্যালু আছে। কাজেই, শুরুটা খুঁড়িয়ে হলেও আস্তে আস্তে বার্লি আস্তিক মানুষের সংখ্যা ঠিকই বেড়ে গেলো।
বার্লির সমস্যা ছিল, এটা স্টোর করে রাখা যায় না অনেকদিন। কাজেই, এমন কিছুর দরকার হল টাকা হিসেবে যাকে ইঁদুরে খেয়ে ফেলবে না বা সহজেই আউনে পুড়ে যাবে না। ব্রেকথ্রু টেকনোলজি হিসেবে এলো রুপার ব্লক। ৮.৩৩ গ্রাম রুপার একটা ব্লক। এই ব্লককে বলা হত শেকেল।
হামুরাবির সংবিধানে যখন বলা হত, কোন অভিজাত পুরুষ যদি কোন দাসীকে হত্যা করে, তবে ক্ষতিপূরণ হিসেবে সেই দাসীর মালিককে ২০ শেকেল দিতে হবে। এই ২০ শেকেল মানে ২০টা রুপার মুদ্রা না। ২০*৮.৩৩= ১৬৬ গ্রাম রুপার কথা বলা হচ্ছে এখানে। বাইবেলেও এই ‘শেকেল’ এর উল্লেখ পাওয়া যায়। ইউসুফ নবীকে তার ভাইয়েরা এই ২০ শেকেলের বিনিময়েই ইসমায়েলীদের কাছে বেঁচে দিয়েছিল।
কালের বিবর্তনে নির্দিষ্ট ওজনের ধাতুকে যে বিনিময়ের কমন মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যায়—এই আইডিয়া আমাদের গ্রেট গ্রেট নানা-দাদাদের মাথায় পাকাপোক্ত হয়ে গেড়ে বসলো।
আমরা যাকে কয়েন বা মুদ্রা বলি, তার আবির্ভাব হয় আজকের তুরস্কে। ৬৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। আগের মতই নির্দিষ্ট ওজনের সোনা/রুপা দিয়ে তৈরি হত এই মুদ্রাগুলো। নতুনত্বটা ছিল অন্য জায়গায়। ইতিহাসে প্রথমবারে মত মুদ্রার উপর রাজ-রাজড়ার নাম খোদাই করা শুরু হয়। এর মানে, স্বয়ং রাজা আমাকে কথা দিচ্ছেন— বৎস, আমার এরিয়ায় তুমি নিশ্চিন্তে এই মুদ্রা ইউজ করতে পারো। কেউ এই মুদ্রার বিনিময়ে তোমাকে কিছু দিতে না চাইলে আমাকে খালি বলবা। আমি তার চৌদ্দপুরুষকে দেখে নিব।
সোনা/রুপার ব্লকে একটা সমস্যা ছিল। ধরা যাক, আপনি আমাকে বাদাম বিক্রির জন্য দুই শেকেল রুপা দিলেন। এখন এই দুই শেকেল রুপা যে পিউর, তার গ্যারান্টি কে দিবে? দিনে আমার একশো জন কাস্টোমার। এখন একশো জনের দেয়া শেকেলের বিশুদ্ধতা যাচাই করতে গেলে আমার আর বাদাম বেচা লাগবে না। রুপার কয়েন যখন চালু হইলো, তখন আমার এই টেনশন রাজামশাই নিজ কাঁধে নিয়ে নিল। কয়েনের উপুর রাজার খোমাখানা প্রিন্ট করার মানে, এইখানে আর যা কিছু প্রিন্ট করা আছে সব কিছুর দায় রাজার। কয়েনের উপর দুই শেকেল লেখা আছে মানে, এইখানে দুই শেকেলই আছে। বা না থাকলেও ক্ষতি নাই। দুই শেকেলের বিনিময়ে বাজারে যা পাওয়া যায়, আমি ঠিক তা-ই পাব।
দেশের রাজার সাথে আমার সরাসরি কোন সম্পর্ক নাই। কোনকালে ছিলও না। যেটুকু সম্পর্ক— তা এই টাকা-পয়সার মাধ্যমে। টাকা-পয়সার তাই যেমন একটা অর্থনৈতিক ন্যারেটিভ আছে। তার পাশাপাশি আছে একটা রাজনৈতিক ন্যারেটিভ। আধ্যাত্নিক ন্যারেটিভ।
যুগে যুগে তাই টাকা জাল করাকে বিরাট অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হইসে। টাকা জাল করা মানে সরাসরি রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা। সোজা কথা, দেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা।