সুতরাং, এইভাবে সমস্যার সমাধান হবে না। কিছু সমাজ একটু অন্যভাবে এই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করসিলো। তারা স্পেশালিস্টদের কাছ থেকে সমস্ত রকম পণ্য আর সার্ভিস কিনে রাখতো। তারপর যার যেটা দরকার, তাকে তার উৎপাদিত পণ্য বা সার্ভিসের বিনিময়ে সেটা দিয়ে দিত। এর সমস্যা হল এই যে, সেন্ট্রালি কালেক্ট করলে আপনি কখনোই ভালো দাম পাবেন না। ভালো দাম না পেলে আপনার মধ্যে কাজ করার বা ভালো জিনিস বানানোর আর উৎসাহ থাকবে না। আপনি চাইবেন, মিনিমাম স্পেসিফিকেশনটুকু মিটায়া কোনমতে পণ্য বা সার্ভিস সাপ্লাই দিতে। সোভিয়েত ইউনিয়নে যেটা হইসিলো।
সমস্যার সমাধান করার জন্য দরকার একটা কমন জিনিস যেটা দিয়ে সবকিছু বিনিময় করা যাবে। সব শ্রেণির এক্সপার্টকে কানেক্ট করার জন্য একটা কমন গ্রাউন্ডের প্রয়োজন হল। আর সেই কমন গ্রাউন্ড তৈরি করলো টাকা। কীভাবে? সেইটা না হয় পরেই বলি।
ছোটবেলায় একটা ব্যাপার নিয়ে আমি বেশ টেনশনে পড়ে গেছিলাম।
আমার আব্বু প্রতিদিন অফিস যেতো টাকা আনতে। কিন্তু অফিসের লোকজন তো খারাপ। এরা আব্বুকে প্রতিদিন টাকা দিতো না। মাসের শুরুতে কোন একদিন হয়তো কিছু টাকা আনতে দিত।
টাকার অভাবে আমরা যখন যা খুশি—তাই কিনতে পারতাম না। নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হত। টাকা যে কেউ ছাপায়–এই ধারণা আমার ছিল। আব্বুকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, সরকার এই টাকা ছাপায়। তখন আমার মনে আইডিয়া এলো, সরকারই যদি টাকা ছাপায়, তাইলে তো সে বেশি বেশি করে টাকা ছাপালেই পারে। তাইলেই তো আর কারো ঘরে কোন অভাব-অনটন থাকবে না।
যে ভুলটা আমি করেছিলাম, সেই একই ভুলটা করেছিল মধ্যযুগে স্পানিশরা। এরা আমেরিকা এসে পিনিকগ্রস্তের মত স্বর্ণ লুটেপুটে নিয়ে গিয়েছিল। এদের এই পিনিক দেখে মেক্সিকোর তৎকালীন অধিবাসী এ্যাজটেকরা খুব অবাক হয়েছিল।
এমন না যে এ্যাজটেকরা কখনো সোনা ব্যবহার করেনি। তারাও এটা দিয়ে গহনা বানাতো, মূর্তি বানাতো। ব্যস, এইটুকুই। সোনা খাওয়া যায় না, পরা যায় না, পান করা যায় না। মোটামুটি আকামের একটা জিনিস। এই আকাইম্যা জিনিস নিয়া ইউরপিয়িদের এতো পিনিক কেনো? এ্যাজটেকরা ইউরোপীয়দের নেতা হার্নান কোর্তেকে একবার জিজ্ঞেসও করেছিলঃ সোনা নিয়া তোমাদের এতো পাগলামো কেনো? কোর্তের উত্তরটা ছিল চমৎকারঃ “I and my companions suffer from a disease of the heart which can be cured only with gold।”
রহস্যটা হচ্ছে এই যে, স্প্যানিশরা স্বর্ণকে বিনিময়ের কমন মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতো। তাই তারা ভেবেছিল, যতো বেশি স্বর্ণ হবে তাদের, ততো তারা বড়লোক হয়ে যাবে। কিন্তু স্বর্ণ তো আসলে টাকা না। ইন ফ্যাক্ট, ‘টাকা’-ও কোন টাকা না। টাকা তাই—যার বিনিময়ে আরেকজন আমাকে কিছু দিবে। সেটা স্বর্ণমুদ্রা না হয়ে কাদামাটিও হতে পারে। দেশের সমস্ত মানুষ যদি এই কাদামাটির বরকতে বিশ্বাস আনে, তবে বিয়েতে হয়তো স্বর্ণ নয়, কাদামাটির ওজন নিয়ে মুরুব্বিদের মধ্যে বাহাস হবে।
বুঝতেই পারছেন, কিছুদিনের মধ্যেই স্পেন দেশে স্বর্ণের ইনফ্লেশন হয়। আগে যে স্বর্ণ দিয়ে পাঁচ কেজি গম কেনা যেত, আজ তা দিয়ে এক কেজিও কেনা যায় না। স্বর্ণ বেড়েছে, সমাজে সম্পদের পরিমাণ তো আর বাড়েনি। আর এই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই বাংলাদেশ সরকার স্রেফ একটা অবুঝ শিশুকে খুশি করার জন্য ইচ্ছেমত টাকা ছাপাতো না।
স্বর্ণ্মুদ্রা আসার আগেও নানাভাবে টাকার প্রচলন ছিল। কখনো শস্যের দানা, কখনো গরু-ছাগলের চামড়া, কখনো বা লবণকে টাকা হিসেবে ব্যবহার করা হত। অনেকে বলেন, ইংরেজি Salt শব্দটা থেকেই Salary শব্দের উৎপত্তি। মধ্যযুগে যুদ্ধের সময় সৈন্যদের বেতন হিসেবে যে লবণ দেয়া হত। সুবে বাংলাতেও যে স্যালারি হিসেবে লবণ দেয়া হত না—তাই বা কে বলতে পারে? ‘নুন খাই যার, গুণ গাই তার’—কথাটা তো আর আকাশ থেকে এসে পড়েনি!
প্রিজন ব্রেক মুভিগুলোতে দেখবেন, সিগারেটকে এখানে টাকা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যার কাছে যতো বেশি সিগারেট, জেলখানার সে ততো বড় হেডম। এমনকি যারা স্মোক করে না, তাদেরও জেলখানায় এই সিগারেট দিয়েই সব কিছু বিনিময় করে। এক প্যাকেট পাউরুটির দাম হয়তো দুইটা সিগারেট, একটা চলনসই ঘড়ি দশটা সিগারেট, এক বোতল বিদেশী মদ বিশটা সিগারেট।
আমরা অবশ্য টাকা বলতে বুঝি ব্যাংকনোটরূপী টাকা। যদিও দুনিয়ার সমস্ত টাকার একটা খুব ক্ষুদ্র অংশ জুড়ে আছে এই ব্যাংকনোট। আজকের দুনিয়ায় টাকা আছে প্রায় ৬০ ট্রিলিয়নের মত। তার মধ্যে ব্যাংকনোট আর কয়েন রূপে আছে মাত্র ৬ ট্রিলিয়ন। প্পরো টাকার মাত্র ১০%। বাকি টাকাটা আছে আমাদের কম্পিউটার সার্ভারগুলোতে। আমাদের দৈনন্দিন কেনাকাটা, বিদ্যুৎ বিল, মোবাইল বিল—সবই আজকাল ইলেকট্রনিক হয়ে যাচ্ছে। বিরাট ক্রিমিনাল ছাড়া আজকাল আর কেউ স্যুটকেস ভর্তি টাকা নিয়ে ঘোরাফেরা করে না
ইলেকট্রনিক ফর্মেই হোক আর ব্যাংকনোট রূপেই হোক, কোন কিছু টাকা হতে হলে সবার আগে যেটা লাগবে—সেটা হল কনভার্টিবিলিটি। রূপান্তরযোগ্যতা। আমি বাদাম বিক্রি করে আপনার কাছ থেকে সার্কিটের ডিজাইন শিখি না। কারন, সেটা আমার কোন কাজে লাগবে না। আমি নিই টাকা। কেননা এই টাকা দিয়ে আমি আবার মুদি দোকানীর কাছ থেকে তেল কিনতে পারবো। টাকা এইভাবে এক পণ্যকে আরেক পণ্যে কনভার্ট করে দিচ্ছে। আপনি হয়তো ঘূষ খাচ্ছে। সেই ঘূষের টাকায় দানখয়রাত করে মানুষের দোয়া কিনে নিচ্ছেন। একজনের সার্ভিস এখানে আরেকজনের দোয়ায় কনভার্ট হচ্ছে।