এই একটা স্রোতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ এক হয়ে মিশে যায়। টাকাকে আমি-আপনি যতোই গালি দিই না কেন, দুনিয়ার মানুষকে কেউ যদি এক করতে পারে, তবে এই টাকাই।
আমেরিকা ছিল লাদেনের এক নম্বর শত্রু। আমেরিকান ক্ষ্টি- কালচার, পলিটিক্স—সব কিছুতেই তার ছিল ভয়ানক বিত্ষ্ণা। সেই লাদেনও কিন্তু আমেরিকান ডলারকে প্রিয়তমার মতোই বুকে আগলে রাখতো।
আমাদের শিকারী পূর্বপুরুষদের মধ্যে টাকা-পয়সার কোন ধারণা ছিল না। এরা দল বেঁধে শিকার করতে যেতো। যা পেতো, তাই ভাগাভাগি করে খেতো। কেউ হয়তো শিকারে বেশি দক্ষ। তাই বলে যে মাংসের ভাগটা বেশি পেত—তা না। যে লোকটা শিকার ভালো জানে না, কিন্তু গাছগাছড়ার রস দিয়ে ক্ষত সারাতে পারে, তাকেও সে সমান ভাগই দিত। এইভাবে একটা অঘোষিত বিনিময় প্রথা গড়ে উঠেছিল তাদের মধ্যে।
ক্ষিভিত্তিক সমাজও কমবেশি একইরকম ছিল। বনেজঙ্গলে ঘোরা মানুষগুলো একটা নির্দিষ্ট গ্রামে এসে থিতু হল। এদের মধ্যেই কেউ ছিল ক্ষত সারানোয় ওস্তাদ, কেউ কাপড় বোনায়, কেউ বা হাতুড়-বাটাল দিয়ে মিস্তিরিগিরিতে। আমরা যাকে বলি ‘স্বনির্ভর অর্থনীতি’–ঠিক সেইটা ছিল তাদের। বাইরের মানুষের সাথে যোগাযোগ করা লাগতোই না বলা যায়। ফুলটাইম ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা দর্জির তাই তখনো প্রয়োজন হয় নাই।
নগর ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা এসে সব কিছু ওলট পালট করে দেয়। শহর মানেই কুটি কুটি লোক। যাদের কেউ কাউকে চেনে না। কাজেই, আমার প্রতিবেশী, যে কিনা দাবি করে সে গাছগাছড়ার রস দিয়ে এক চুটকিতে আমার ক্ষত সারায়ে দিতে পারবে—তার এই দাবির সত্যমিথ্যা আমি জানি না। এই অবিশ্বাস থেকে জন্ম হল স্পেশালাইজেশনের। জন্ম নিল স্পেশালাইজড ডাক্তার, মিস্তিরি আর দর্জি।
স্পেশালাইজেশনের প্রভাব পড়লো গ্রামেও। একটা গ্রামে হয়তো পুইঁশাকের ফলন ভালো হয়। শহরের লোকে ভাবলো, কী দরকার কষ্ট করে বাড়ির পেছনে পুঁইশাক ফলানোর? এর চেয়ে ঐ গ্রাম থেকে কিনলেই তো হয়। ধীরে ধীরে এই গ্রামের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। অন্য গ্রামগুলোও বসে রইলো না। যে ফসলটা তারা অতো ভালো ফলায় না, সেই ফসল তারা ফলানোই ছেড়ে দিল। সমস্ত মনোযোগ দিল যেই ফসল ভালো ফলে, তার উপর। এইভাবে আরেকটা গ্রাম হয়তো টমেটোর দিক দিয়ে, আরেকটা গ্রাম আলুর দিক দিয়ে নিজেকে স্পেশালাইজ করে নিল।
স্পেশালাইজেশনের ফলে কনজ্যুমার হিসেবে শহরের মানুষের সুবিধা হল। কিন্তু ওভারঅল অর্থনীতি হয়ে পড়লো জটিল। আর অর্থনীতি যতো কমপ্লেক্স হয়, বিনিময় প্রথা ততো অকার্যকর হতে থাকে। আগে গ্রামে থাকতে পাশের বাড়ির বৌদির কাছ থেকে কলাটা-মূলাটা আনা যেত। জানা কথা যে, সেও একদিন তার কাছ থেকে মাছের কুটোটা বিনিময়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু শহরে তো এই সুবিধা নাই। যে ধনঞ্জয় আমার ধরা ইলিশ মাছের বিনিময় কাল দেবে বলে নিয়ে গেলো, কাল কেন— সারা জীবনেও তার সাথে আমার আর দেখা নাও হতে পারে।
বিনিময় প্রথার অসুবিধা বোঝানোর জন্য একটা উদাহরণ দিই।
ধরা যাক, আপনার আমের বিরাট বাগান। সেইখানে ল্যাংড়া, ফজলি, মোহনভোগ—নানা স্বাদের আম ফলে। একদিন আপনার জুতা গেছে ছিঁড়ে। আপনার প্রতিবেশীর কাছে আপনি শুনলেন, নদীর ঐপারে বাজারে এক মুচি আছে। তাকে দিয়া সে জুতা ঠিক করাইসিলো। আজ পাঁচ বছর হইসে, সেই জুতার কিচ্ছু হয় নাই। তো আপনি নাচতে নাচতে মুচি ভদ্রলোকের কাছে গেলেন। আশা, কয়টা আমের বিনিময়ে তার জুতা ঠিক করায়ে নিবে।
মুচি বেচারা পড়লো বিপদে। গত সপ্তাহেই সে তিনটা ফজলি আমের বিনিময়ে একজনের জুতা ঠিক করে দিসিলো। তিনটা নাকি চারটা? তার এখন ঠিক মনে পড়তেসে না। প্রতিদিন তো সে কতো কিছুর বিনিময়ে কতোজনের জুতাই ঠিক করে দেয়। ধান, গম, মাংস, কাপড়-চোপড়—দ্যা লিস্ট গোজ অন। এতো কিছুর ভীড়ে আমের হিসাব মাথায় থাকে নাকি?
ধরা যাক, তিনটাই আম। এইখানেও সমস্যা। তিনটা আমের বিনিময়ে সে এক কিশোরীর জুতা ঠিক করে দিসিলো। আর এটা পূর্ণবয়স্ক পুরুষের বুট। এর জন্যও কি তিনটা আম চাওয়া ঠিক হবে? কয়টা চাইলে সে ঠকবে না? বেশি আম না হয় নিল। বেশি আম নিয়ে সে করবেটা কী? বাসায় খালি সে আর তার বউ। ফ্রীজও নাই যে আম প্রিজার্ভ করে রাখবে। বেশি নিলে শুধু শুধু এটা পচবে।
আরেকটা কনসার্ন আছে তার। অতি সম্প্রতি দেশে একটা ছোঁয়াচে রোগের আমদানি হইসে। কাতারে কাতের গরু-ছাগল সেই রোগে আক্রান্ত হইতেসে। কাজেই, চামড়ার সাপ্লাই গেছে কমে। আগে এক জোড়া জুতার বিনিময়ে সে যতোটুকু চামড়া পাইতো, এখন তার অর্ধেক পায়। এই ব্যাপারটাও তো কনসিডার করতে হবে।
এতো কিছু বিবেচনায় আনতে গিয়ে তার মাথামোথা গরম হয়ে গেল। নিজের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য সে আপনাকে ‘ভাংতি নাই’ বলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল। এই সমস্যা যে খালি ঐ মুচি ভদ্রলোকই ফেস করছে—তা না। গোটা বাজারে যদি ১০০টা পণ্যের ১০০ জন বিক্রেতা থাকে, তবে তাদের মধ্যে ৪৯৫০ রকম এক্সচেঞ্জ রেট থাকবে। পণ্যের সংখ্যা বেড়ে যদি ১০০০ হয়, তবে এই এক্সচেঞ্জ রেটের সংখ্যা হবে ৪৯৯৫০০। একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে এই রেট মনে রাখা সম্ভব না।
অবস্থা আরো খারাপ হইতে পারে যদি মুচি ভদ্রলোক বা তার স্ত্রী—কারোরই আমের প্রতি ভালোলাগা না থাকে। হয়তো দু’জনের মধ্যে বেশ খটাখটি চলছে এখন। মুচি ভদ্রলোকের এখন আম্র দরকার না, দরকার একজন ডিভোর্স লইয়ার। এক্ষেত্রে যেটা হতে পারে—আপনি এক ডিভোর্স লইয়ারকে খুঁজে বের করবেন, যার কিনা আম পছন্দ। আপনার আমের বিনিময়ে সে মুচির ডিভোর্স করায়ে দিবে। মুচি তার বিনিময় দিবে আপনার জুতা ঠিক করে। ডিরেক্ট বিনিময় না হয়ে এটা হল ইনডিরেক্ট বিনিময়। তিনধারী লেনদেন। কিন্তু আপনি যে ঐদিনই একজন আমখোর ডিভোর্স লইয়ার খুঁজে পাবেন–তার গ্যারান্টি কী?