এটা যীশুর জন্মের ১২০০ বছর আগের ঘটনা। তারও আগে থেকেই মেয়েদের অশুভ হিসেবে দেখার একটা প্রবণতা চলে আসছে অধিকাংশ সমাজ জুড়েই। বাইবেলে তো মেয়েদের বরাবরই ‘সম্পত্তি’ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
বাইবেলের দর্শনটাই ছিল এরকম যে, কোন মেয়েকে ধর্ষণ করলে সেটা ভিকটিমের প্রতি কোন অন্যায় নয়। মেয়েটা যার সম্পত্তি, হোক সেটা তার বাপ, ভাই বা অন্য কোন আত্নীয়, তার প্রতি অন্যায়। বাইবেল তাই বলছে, কোন দুষ্টলোক যদি কোন কুমারীকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে, তবে সেই লোকের কাছ থেকে কিছু গয়নাগাটি নিয়ে মেয়েটিকে সেই লোকের কাছে বিয়ে দিয়ে দাও।
যে বাইবেল চোখের বদলা চোখ, দাঁতের বদলা দাঁত আর জানের বদলা জান ঘোষণা করে, সেই কিনা ধর্ষণের বদলা রেখেছে বিয়ে। মজার ব্যাপার হল, বাইবেলের সেই লিগ্যাসী প্থিবীর অনেক সমাজ এমনকি আমরাও জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে এখনো বহন করে চলেছি। আর যে মেয়েটা কারো সম্পত্তি নয়, তাকে ধর্ষণ করা তো রীতিমত জায়েজ। অনেকটা রাস্তায় একটা কয়েন কুড়ায়া পাইলাম। পকেটে করে নিয়ে গেলাম। এরকম একটা ব্যাপার।
আর স্বামী যদি স্ত্রীকে ধর্ষণ করতো, সেটা তো কোন অপরাধের পর্যায়েই পড়তো না। আইডিয়াটা ছিল এরকম, স্ত্রীর প্রতি তো স্বামীর সম্পূর্ণ অধিকার আছেই। বাই ডিফল্ট, স্ত্রীর সেক্সুয়ালিটি-ও স্বামীর অধিকারেই পড়ে। স্বামী স্ত্রীকে ধর্ষণ করা যা, নিজের মানিব্যাগ থেকে নিজে টাকা চুরি করা তাই।
আগেই বলেছি, এই রকম চিন্তাধারা যে কেবল মধ্যপ্রাচ্যে সীমাবদ্ধ ছিল–তা না। ২০০৬ সালে প্থিবী জোড়া ৫৩টি দেশে এই ‘অপরাধ’ এর কোন শাস্তি ছিল না। আধুনিক, মুক্তমনা দেশ যে জার্মানি, তারা তাদের আইনে এই ক্যাটাগরীকে নিয়ে এসেছে সিতো সেদিন। ৯৭ সালে।
যে এথেন্সকে আমরা প্রাচীন সভ্যতার চূড়া ধরি, সেই এথেন্সের নগর রাষ্ট্রেও নাগরিক হিসেবে নারীদের কোন অংশরহণ ছিল না। সক্রেটিস সব কিছু নিয়ে প্রশ্ন করে গেছেন, কিন্তু নারীরা কেন নাগরিক নয়, তারা কেন বিচারসভায় জুরির আসনে বসতে পারে না——এই প্রশ্নগুলো করতে বেমালুম ভুলে গেছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, নারীর প্রতি এই যে বৈষম্য, দেশ-কাল নির্বিশেষে তাদের ঊন-মানুষ হিসেবে দেখার এই যে প্রবণতা—এটা কি প্রক্তিরই কোন নিয়ম? নাকি আর দশটা বৈষম্যের মত এটাও মানুষের ইমাজিনড হায়ারার্কির ফসল?
এটা বুঝতে হলে আমাদের কোনটা প্রাক্তিক আর কোনোটা প্রক্তিবিরুদ্ধ—সেটা বুঝতে হবে।
এইখানেও ভেজাল আছে।
আপনি যদি ছেলে হয়ে এক ছেলেকে কিংবা মেয়ে হয়ে আরেক মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তোলেন, আপনার আম্মু হয়তো শকে বা শোকে অজ্ঞান হয়ে যাবেন। ন্যাচার আম্মু কিন্তু অজ্ঞান হবে না। সে অনেক কুল। তার কাছে সবই স্বাভাবিক।
আপনি যে মুখ দিয়ে চুমু খান, সে মুখ কিন্তু বেসিক্যালী তৈরি হয়েছিল খাবার খাওয়ার জন্য। খাবার খাওয়াটাই স্বাভাবিক, চুমু খাওয়াটাই অস্বাভাবিক। কিন্তু হাজার বছরের বিবর্তনে মুখ দিয়ে চুমু খাওয়াটাকে আমাদের কাছে এখন আর অস্বাভাবিক বা প্রক্তিবিরুদ্ধ মনে হয় না।
মশা-মাছির যেমন এককালে পাখা ছিল না। আকস্মিক মিউটেশনের কারণে পতঙ্গের শরীরে একটা এক্সটেনশন তৈরি হয়। এতে করে তাদের শরীরের ক্ষেত্রফল বেড়ে যাওয়ায় তারা বেশি বেশি করে সূর্যালোক তথা এনার্জি সংগ্রহ করতে পারে। বেশি ক্ষেত্রফলওয়ালা এই পতঙ্গরা খুব স্বাভাবিকভাবেই অন্যদের চেয়ে এ্যাডভাণ্টেজ পেয়ে যায়। তারপর হঠাৎই একদিন এই এক্সটেনশন দিয়ে তারা গ্র্যাভিটিকে পরাভূত করতে সক্ষম হয়। অবশ্যই তারা এক লাফে আকাশে ওড়া শিখে যায় না। প্রথমে হয়তো মাটি ছেড়ে এক ধাপ উপরে উঠা শিখে। তার বাচ্চা আরেক ধাপ, তার বাচ্চা আরেক ধাপ। এই করে করে মশা-মাছি আজ আমাদের কানের কাছে এসে গুণগুণ করার ক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছে।
এখন আপনি যদি সেই মশাকে ডেকে বলেন, এই ব্যাটা। তোর পূর্বপুরুষ তো উড়তে পারতো না। তুই প্রক্তির নিয়ম ভেঙে আমার কানের কাছে ওড়াওড়ি করছিস কেন? মশা সুন্দর করে আপনার কানের নিচে ঠাটিয়ে দুটো চুমু দিয়ে বিদায় নিবে।
কাজেই, ন্যাচারাল বা আনন্যাচারাল বলে আসলে কিছু নেই। সবই আমাদের ডিফাইন করে দেয়া কতগুলো ফ্রেম বা কাঠামো। প্রক্তিই নারীদের এমন করে তৈরি করেছে—এই ধারণারও তাই কোন ভিত্তি নেই। প্রক্তি আমাদের চয়েস দেয় কেবল। সেখান থেকে যে যার মত অপশন বেছে নেয়।
ইতিহাস জুড়ে নারীদের তবে এই দুর্দশা কেন? এই নিয়ে আরেক দিন আলাপ হবে। আজ এইটুকুই।
শারীরিক দুর্বলতার কারণেই মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে পিছিয়ে আছে—এটা আসলে ছোটবেলার পরীক্ষার খাতার ১ নং প্রশ্নের মুখস্থ উত্তর হয়ে যায়। সেটাই যদি হত, তবে ষাট বছরের বুড়োরা তিরিশ বছরর ছুড়োদের উপর ছড়ি ঘোরাতো না। কিংবা তুলনামূলক দুর্বল শাদারাও শক্তিশালী কালোদের শত শত বছর ধরে পায়ে শিকল পরিয়ে রাবার বাগানে কাজ করতে বাধ্য করতে পারতো না।
হাঁ, অন এভারেজ, ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে শক্ত—এটা ঠিক। কিন্তু ইন্ডিভিজুয়ালি, প্রতিটা পুরুষই যে প্রতিটা নারীর ছেয়ে শক্তিশালী–তা কিন্তু নয়। তার চেয়েও বড় কথা, ক্ষুধা-ত্ষ্ণায়, অসুখ-বিসুখে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে অনেক বেশি রেজিস্টান্ট। একটা ছোট্ট সার্ভে করেন। মনে করে দেখেন তো, আপনার বাবা সারা জীবনে কয়বার অসুখে পড়েছেন আর আপনার মা ক’বার পড়েছেন? তাহলেই বুঝবেন মেয়েদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কতো বেশি।