পশ্চিম ছেড়ে এবার পূর্বে যাত্রা করি। হিন্দুরা মনে করে, ভগবান পুরুশা নামক এক প্রাচীন সত্তার শরীর থেকে মানবজাতিকে তৈরি করেছেন। পুরুশার মুখ থেকে তৈরি করেছেন ব্রাহ্মণদের (তাই তারা মন্ত্রপাঠ করে), বাহু থেকে তৈরি করেছেন ক্ষত্রিয়দের (তাই তারা যুদ্ধ করবে), বৈশ্যদের ঊরু থেকে আর শূদ্রদের পা থেকে। যে মুহুর্তে আমরা এই মিথে বিশ্বাস স্থাপন করছি, ঐ মুহূর্তে আমরা ব্রাহ্মণ আর শূদ্রদের মধ্যকার সমস্ত বৈষম্যের সোশ্যাল জাস্টিফিকেশন দিয়ে দিচ্ছি। এই ধরনের বিশ্বাস যে কেবল সনাতন ধর্মমতেই সীমাবদ্ধ ছিল— তা না। চাইনিজদের মধ্যেও এই ব্যাধি ছিল প্রবল। চাইনিজরা বিশ্বাস করতো, ঈশ্বর যখন মাটি দিয়ে মানুষ বানালেন, তখন তিনি অভিজাতদের বানালেন মিহি হলুদ মাটি দিয়ে আর আমজনতাকে বানালেন কাদামাটি দিয়ে।
হায়ারার্কি কি কেবল গায়ের রঙে হয়? কিংবা মিথের জোরে হয়? হায়ারার্কি অর্থের জোরে হয়, বিত্তের জোরে হয়, ক্ষমতার জোরে হয়। একটা সময় ছিল যখন শাদাদের স্কুলে কালোরা পড়তে পারতো না। শাদাদের জন্য আলাদা বাস, বীচ—সবই ছিল। বাসের গেটে লেখা থাকতো—Dogs and blacks are not allowed. এখন সেই অবস্থার উত্তরণ হয়েছে। আজ একটা শাদা পাড়ায় কালো লোক বাড়ি ভাড়া নিতে গেলে কেউ অবাক হয় না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, গোটা স্ট্রাকচারটাই এমন হয়ে আছে, যে শাদাদের পাড়ায় বাড়ি ভাড়া নেবার সামর্থ্যও একটা কালো লোকের থাকে না। ফলে আইনগতভাবে না থাকলেও বাস্তবে সেই বৈষম্যগুলো রয়েই গেছে।
বিত্তবানরা খুব স্থূলভাবেই নিজেদের সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে আলাদা করে রেখেছে। নিজেদের ছেলেমেয়েদের জন্য পশ স্কুলের ব্যবস্থা করে রেখেছে। এমন একটা অর্থনৈতিক ব্যারিয়ার তৈরি করে রেখেছে সেখানে, একটা ক্ষকের ছেলে যতো মেধাবীই হোক না কেন, সেইসব স্কুলে পা মাড়াতে পারবে না। তাকে হয় সরকারি প্রাইমারি স্কুলে যেতে হবে নয়তো মাদ্রাসায়। আপনি একজন কালো দিনমজুরকে দেখবেন না সাউথ ইস্ট ব্যাঙ্কে টাকা তুলতে বা এ্যাপোলো হসপিটালের করিডোরে হাঁটাহাঁতি করতে। তাদের বড়জোর ইসলামী ব্যাঙ্কে টাকা গুণতে দেখা যেতে পারে বা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বারান্দায়।
কে লুঙ্গি পরে এলো আর কে জিন্স পরে এলো—এটা তাই না চাইতেও আমাদের অনেক আচরণ ঠিক করে দেয়। নিজের অজান্তেই আমরা তখন আমেরিকার ঐ জাতির পিতাদের মত হিপোক্র্যাটের দলে নাম লেখাই।
দাসপ্রথার ইতিহাস খুব নতুন নয়। রোমান সাম্রাজ্যের সময় থেকেই এটা প্রচলিত ছিল। এক রাজ্য আরেক রাজ্যকে যুদ্ধে হারিয়ে দিলে পরাজিত রাজ্যের নারী-পুরুষকে দাস হিসেবে খাটানোর প্রথা ছিল। গায়ের রঙের সাথে এর কোনরকম সংযোগ ছিল না তখন।
দাসপ্রথার সাথে বর্ণবাদের সংযোগ ঘটে মধ্যযুগে। ইউরোপ তখন আফ্রিকা দখল করে নিচ্ছে। এশিয়ায় অভিযান চালাচ্ছে। আমেরিকা নামে একটা নতুন মহাদেশও আবিষ্কার করেছে। ইউরোপের লোভ আর দুরন্ত শক্তিমত্তার কাছে গোটা দুনিয়া তখন অসহায়।
উপনিবেশ থেকে পাওয়া স্বর্ণ আর সম্পদে ইউরোপীয়দের অর্থনীতি ফুলে ফেঁপে উঠছে। এই অর্থনীতির জোয়াল কাঁধে নেবার জন্য তাদের প্রয়োজন ছিল শ্রমিকের। সস্তা শ্রমিকের।
আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানরা এই শ্রমের যোগান দিতে পারছিল না। রেড ইন্ডিয়ানরা ছিল অতিমাত্রায় স্বাধীনচেতা। কোন রকম ভয়ভীতি দেখিয়ে বা ধর্মীয় গ্রন্থের দোহাই দিয়ে তাদের বশে আনা যায়নি। ফলশ্রুতিতে কখনো ছলেবলেকৌশলে, কখনো বা কোনরকম ভণিতা ছাড়াই অসম যুদ্ধে তাদের লিটার্যালী মেরে ফেলতে হয়েছে। গণহারে তাদের দাস হিসেবে খাটানো সম্ভব হয়নি যেটা করা গেছে আফ্রিকার দাসদের সাথে।
জাহাজ বোঝাই করে দলে দলে দাস আমদানি করা হয়েছে ইউরোপ আর আমেরিকায়। কালোদের ন্যূনতম মানবিক অধিকারকে অস্বীকার করে তাদের খাটানো হয়েছে অমানুষিক পরিশ্রমের সব কাজে। ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যাণ্ডের মত প্রভাবশালী সব ব্যাঙ্কের জন্মই এই দাস ব্যবসাকে কেন্দ্র করে।
অথচ ইউরোপে তখন কিন্তু রেনেসাঁস শুরু হয়ে গেছে। মানুষে মানুষে সাম্য, মৈত্রী আর স্বাধীনতার বার্তা প্রবাহিত হচ্ছে দিকে দিকে। এমন একটা সময়েও ওরা কীভাবে পারলো কালোদের এরকম মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করতে?
একটা ব্যাখ্যা তো মাত্রই দিলাম। অর্থবীতির চাহিদা আর যোগানের খেল।
কস্ট মিনিমাইজ করাও ছিল একটা ফ্যাক্টর। আফ্রিকা ছিল আমেরিকার কাছের বাজার। সেনেগাল থেকে একটা দাস কিনে আনতে তার যে পরিমাণ ট্রান্সপোর্টেশন কস্ট হত, ভিয়েতনাম থেকে আনতে গেলে তার চেয়ে বেশিই হবে। শুধু শুধু কেন সে ভিয়েতনাম যাবে দাস আনতে?
তার উপর আগে থেকেই আফ্রিকা থেকে দাসের একটা সাপ্লাই চেইন গড়ে উঠেছিল মধ্যপ্রাচ্যের চাহিদা মেটানোর জন্য। আরব্য রজনীর পাতায় পাতায় দেখবেন আফ্রিকানদের দাস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, খোঁজা করে হেরেমে রাখা হচ্ছে। অর্থনীতির নিয়মই হল, নতুন বাজার খোঁজার চেয়ে এগজিস্টিং বাজার থেকে কেনাকাটা করাই ভালো। আমেরিকাও সেই পথেই গেলো।
সবচেয়ে বড় কথা—আমেরিকার যে ফার্মগুলা ছিল, ভার্জিনিয়া, হাইতি আর ব্রাজিলে, সেগুলো ছিল প্লেগের আখড়া। ইউরোপীয়রা যেখানে প্লেগকে যমের মত ভয় পাইতো (আলবেয়ার কামু তো কয়েকশো পাতার উপন্যাসই ফেঁদে বসেছেন এই প্লেগকে নিয়ে), আফ্রিকানদের শরীরে সেখানে এইসব রোগবালাইয়ের বিরুদ্ধে একটা ইম্যুনিটি তৈরি হয়ে গেসিলো। ইম্যুনিটি তৈরি হওয়া শরীরের জন্য ভালো। কিন্তু সোশ্যাল পিরামিডে আপনার অবস্থানের জন্য ভালো কিনা—তা বলে দেবে ঐ সময় আর ঐ সময়ের পাওয়ার মেকানিজম। অভিজাত ইউরোপীয়রা (ব্রিটিশ, ফ্রেঞ্চ, আইরিশ) তাই গরীব ইউরোপীয়দের (ইউক্রেন, গ্রীস কিংবা বেলারুশের অধিবাসীদের) দাস না খাটিয়ে দাস খাটালো শক্ত সামর্থ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন আফ্রিকানদের।