ব্যুরোক্রেসির আরেকটা বদনাম হচ্ছে এরা মানুষের খাটনির উপর যত্রতত্র ট্যাক্স বসিয়ে নিজেদের রুটি রোজগার করে। মিশরীয় ব্যুরোক্রসি ছিল এক্ষেত্রে সেরা। অন্তত প্রাচীন যুগে। ধরা যাক, এক লোক এ্যালকোহল উৎপাদন করবে। এর জন্য তাকে পয়সাকড়ি দিয়ে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হবে। এই ট্রেড লাইসেন্স ব্যাপারটা আমাদের কাছে পরিচিত হলেও সেকালে ছিল একেবারেই অনন্য। কেবল মিশরীয়রাই এই গোপন রহস্যের কথা জানতো। রোমানরাও না, ফিনিশীয়রাও না।
তারপর তাকে সরকারী কোন কোম্পানি থেকে বার্লি কিনতে হত। সেই বার্লির উপর এক দফা ট্যাক্স বসবে। উৎপাদন করার পর তাকে বিক্রিও করতে হবে সরকারী কোন কোম্পানির কাছে। সেইখানে আরেক দফা সেলস ট্যাক্স। সরকার সেটা সীল টীল দিয়ে আবার হয়তো সেই লোকের কাছেই বিক্রি করবে। এবার কেনার সময় তাকে আরেক দফা ট্যাক্স দিতে হবে। অনেকটা বাংলাদেশের গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির মত। আমাদের ট্যাক্স দিয়ে কাঁচামাল কিনতে হয়। সেইটা দিয়ে আমরা জামাকাপড় বানাই। সেটা বাইরে চালান করি সীল লাগানোর জন্য। থাইল্যান্ড থেকে সেটা সীল সমেত আমাদের রেক্স বা কেলভিন ক্লেইনে জায়গা করে নেয়। আমরা সেটাই আবার বেশি দামে কিনে নিই।
ব্যুরোক্রেসির সবটুকুই যে খারাপ—তা নয়। ইতিহাস বারবার সাক্ষ্য দেয় যে, যেখানেই ব্যুরোক্রেসির বিকাশ হয়েছে, সেইখানেই গণিতের বিকাশ হয়েছে। সেটা চাইনিজ ব্যুরোক্রেসি হোক কিংবা মিশরে। যতো বড় সাম্রাজ্য, ততো বেশি ডাটা। আর এই ডাটা সংরক্ষণ করার জন্য গণিতবিদদেরও সারাক্ষণ দৌড়ের উপর থাকতে হয়েছে। নিত্য নতুন গণনা পদ্ধতি আবিষ্কার করে সাম্রাজ্যের চাহিদা মেটাতে হয়েছে।
আজ যারা সমাজের এলিট, তারা সবাই এই গণিতের ভাষাতেই কথা বলেন। বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, ইকোনমিস্ট থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদেরা পর্যন্ত। মানুষের সুখ আজ মাপা হয় জিডিপি দিয়ে। আপনি সৎ কিনা মাপা হয় আপনার ক্রেডিট স্কোর দিয়ে। আপনি প্রেমিক হিসেবে সফল কিনা–মাপা হয় আপনারা কয়টা বসন্ত একসাথে পার করেছেন, সেই সংখ্যা দিয়ে।
গণতন্ত্র হোক আর একনায়কই হোক—ব্যুরোক্রেসি না হলে কারোরই চলে না। দিন শেষে আমরা এই কচ্ছপকে গালি দিই, অভিশাপ দিই—যাই করি, যতো নতুন সমাজের স্বপ্নই দেখি না কেনো—সেই প্রতিটা নতুন সমাজেই কোন না কোন ফর্মেটে এই ব্যুরোক্রেসি থাকবেই।
০৫. হিপোক্র্যাট-হিপোক্র্যাসি
মানুষ দুই রকমের। এক, যারা হিপোক্র্যাট। আর দুই, যারা হিপোক্র্যাট।
ইতিহাসের বড় সময়টা জুড়েই আমরা হিপোক্র্যাসি করে এসেছি। আর প্রায়ই সেটা এতো উঁচু লেভেলের হিপোক্র্যাসি হয় যে, আমরা যে হিপোক্র্যাট—ঐ সেন্সটুকুও আমাদের মাথায় আসে না।
১৭৭৬ সালের সংবিধানে আমেরিকানরা যখন ঘোষণা করে, সকল মানুষ সমান, তখন তারা মানুষ বলতে কেবল শাদা চামড়াদেরই বোঝাচ্ছিল। আরো স্পেসিফিক্যালী বলতে গেলে, শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের। নারীদেরও সেই সমাজে কোন বিশেষ স্থান ছিল না। ভোটাধিকারই ছিল না; রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি—এইসব বিষয়ে কোন ‘say’ থাকা তো দূরের কথা।
বলা বাহুল্য, নিগ্রো দাসেরাও ছিল সিলেবাসের বাইরের মানুষ। যারা আমেরিকার জাতির জনক ছিলেন, এই সংবিধানে যারা সাক্ষর করেছিলেন, তাদের নিজেদেরও প্রচুর দাস ছিল। দাসদেরও তো যে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে—এই চিন্তাটাই তাদের মাথায় আসেনি। কিংবা এলেও নিজেদের স্বার্থের খাতিরেই একে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছেন। নিজের স্বার্থ তো পাগলেও বোঝে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, অনেকে আবার এটাকে খোদার ইচ্ছা বা প্রক্তি মায়ের ইচ্ছা বলে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করে। । দাসপ্রথা যে ইতিহাসের পথ ধরে মানুষেরই উর্বর মস্তিষ্কের আবিষ্কার—এটা তারা মানতেই চায় না। হামুরাবি যেমন তার দেয়া বিধিবিধানকে আল্লাহর নামে চালিয়ে দিতে দ্বিধা করেননি। উনি জানতেন, আল্লাহর নামে কিছু একটা চালিয়ে দিলে কেউ তা অমান্য করার সাহস পাবে না।
এরিস্টটটল ছিলেন এক ধাপ এগিয়ে। উনি মনে করতেন, অভিজাত মানুষেরা এক রকম অভিজাত মানসিকতা নিয়েই জন্মায়। আর দাসেরা জন্মই নেয় দাস মেন্টালিটি নিয়ে। কাজেই, যে দাসের ঘরে জন্মেছে, তার মেন্টালিটি অমন বলেই সে এই ঘরে জন্মেছে। মেন্টালিটি ভালো হলে কোন উঁচু বংশেই জন্মাতো।
শ্বেতাঙ্গরা তো মনেই করে, তাদের রক্তে এমন কিছু আছে যা তাদের অন্যদের চেয়ে উন্নততর মানুষে পরিণত করে। তাদের এই ভাবনাকে জ্বালানি দেয় বিশ শতকের শুরু দিকে আমেরিকায় ‘ইউজেনিক্স’ নামে একটি আন্দোলন। বিজ্ঞানের মোড়কে এর মূল বক্তব্য হচ্ছে, রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষা করে বেটার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্ম দেয়া। হরলিক্সের ভাষায়—টলার, স্ট্রংগার, শার্পার প্রজন্মের জন্ম দেয়া। বিশুদ্ধ রক্ত মানে অবশ্যই শ্বেতাঙ্গ রক্ত। আর্য রক্ত। ককেশিয়ান রক্ত।
উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার। আমেরিকায় সেই সময় ইমিগ্র্যান্টদের একটা প্রবল স্রোত ঢুকছিল। গোঁড়া আমেরিকানদের ভয় ছিল, ইমিগ্র্যান্টদের রক্তের সাথে ইউরোপীয় আমেরিকানদের রক্ত মিশে একটা দূষিত প্রজন্ম তৈরি হবে। কাজেই, এই দূষিত প্রজন্মের হাত থেকে আমেরিকাকে বাঁচাতে হবে।
কার্নেগী ফাউন্ডেশন, রকাফেলার ফাউন্ডেশনের মত বড় বড় পুঁজিপতিরা একে প্রোমোট করতে থাকে। রকাফেলার ফাউন্ডেশন তো খোদ হিটলারের জার্মানিতে একে ফান্ড করে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ নিয়ে কোর্স চালু হয়। রিসার্চ চলতে থাকে পুরোদমে। মানুষ যে বৈষন্য রীতিমত পছন্দ করে, অন্তত যেখানে নিজের স্ট্যাটাস কো ধরে রাখলে সুবিধা পাবে—এটা তার প্রমাণ।