সুমেরিয়ান বর্ণমালাকে অবশ্য পূর্ণাঙ্গ বর্ণমালা বলা যায় না। এতে অল্প কিছু কাজই হত। মূলত অফিশিয়াল কাজ সব। আমাদের জন্য রেখে যাওয়া আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রথম মেসেজও অফিশিয়াল। মেসেজটা এরকমঃ “২৯০৮৬ মণ বার্লি, ৩৭ মাস, কুশিম।” এর অর্থ সম্ভবত এরকমঃ বিগত ৩৭ মাসে ২৯০৮৬ মণ বার্লি সংরহ করা হইসে। সাক্ষরে, কুশিম।
ইতিহাসের প্রথম টেক্সটে কোন কবিতা নাই, কোন ফিলোসফি নাই, এমনকি কোন রাজ-রাজড়ার যুদ্ধজয়ের গল্পও নাই। আছে কাঠখোট্টা হিসাব নিকাশ।
আমাদের প্রথম চিন্তা তাই কোন মহৎ চিন্তা নয়। ধর্মীয়, সামাজিক,আধ্যাত্নিক কোন উঁচু স্তরের চিন্তা নয়। আমাদের প্রথম চিন্তা চাল, ডাল তেল আর নুনের চিন্তা। পেটের চিন্তা, পিঠের চিন্তা।
উঁচু স্তরের চিন্তা যে একদমই ছিল না–তা নয়। হোমার কোন রকম লিখিত ভাষার সাহায্য ছাড়াই মহাকাব্য রচনা করে গেছেন। মানুষের মুখে মুখে সেই কবিতা ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু আপনি যখন খাজনা আদায় করতে যাবেন, তখন মুখের ভাষায় কাজ হবে না। কে কতোটুকু খাজনা দিয়েছে, তা লিখে রাখতে হবে। কবিতা আর খাজনা দুটো পরস্পরবিরোধী ব্যাপার হলেও এই দিয়ে মিলেই জন্ম দিয়েছে আমাদের পূর্ণাঙ্গ ভাষার।
এই সময়ের আরেকটা স্ক্রিপ্ট আমরা হাতে পাই। এতে অল্প কিছু শব্দ বার বার লিখা আছে। ‘৪০ মণ ধান’, ‘৪০ মণ ধান’, ‘৪০ মণ ধান’—এরকম কিছু একটা হবে। সম্ভবত কোণ নাদান বালকের হোমওয়ার্ক-এর খাতা এটি। সেকালে পড়াশোনা করে ছেলে আমলা হবে—এই চিন্তা থেকেই অভিজাতেরা তাদের সন্তানদের শিক্ষা দিত। পড়াশোনা করে কেউ হোমার বা মধুসূদন হবে—এই চিন্তা তারা মাথাতেও আনতো না।
এর কারণও ছিল। লেখালেখি ছিল খুবই কষ্টসাধ্য কাজ। আজকের মত কীবোর্ডে টাইপ করে বা কাগজে ঘষঘষ করেই কিছু একটা লেখা যেত না। লিখতে হত মাটির ট্যাবে। আজকের ট্যাবে লেখা যতোটা সোজা, মাটির ট্যাবে লেখাটা ছিল ততোটাই কঠিন। কেউ আর তাই কষ্ট করে মাটির ট্যাবে গল্প-উপন্যাস লিখতে যেত না। স্রেফ এবং স্রেফ হিসাবপত্তর করার জন্যই ঐ খাটনিটুকু খাটতো।
ইনকারা এক বিশেষ রকমের ভাষা ব্যবহার করতো। ওরা কিছু দড়ি পাশাপাশি সাজাতো। সেই দড়িগুলো দিয়ে নানা রকমের গিট্টু বাঁধতো। গিট্টুগুলোকে আবার নানা রঙে রাঙাতো। দড়ি, গিট্টু আর রঙের পারমুটেশন-কম্বিনেশন করে ওরা ওদের দৈনন্দিন যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগকরে নিত। গোটা ব্যাপারটা এখনো গবেষণার বিষয়। (ছবি ৩ ও ৪)
স্প্যানিশরা যখন প্রথম দক্ষিণ আমেরিকায় আসে, তখনো এই কিপোর চল ছিল। দেখা গেল, কিপোর মাধ্যেম হিসাব-নিকাশ করতে গিয়ে স্থানীয়দের সাহায্য নিতে হচ্ছে। স্থানীয়রা স্প্যানিশদের কিপো অজ্ঞতার সুযোগে নানা রকম ঠক-জোচ্চোরি করছে। আস্তে আস্তে স্প্যানিশরা যখন গোটা মহাদেশ দখল করে নিল, তখন এই ভাষা বাতিল করে নিজেদের ল্যাটিন স্ক্রিপ্ট চালু করলো। কিপো চলে গেলো ইতিহাসের খরচের খাতায়। কিপোর অর্থ উদ্ধার করার মত আর একটা লোকও এক সময় জীবিত রইলো না।
খ্রিস্টপূর্ব ১৭৭৬ সালের এক সকাল।
রাম আর শামের মধ্যে জমি নিয়ে বিবাদ লাগলো। রাম বলে, এই জমি সে শামের কাছ থেকে তিরিশ বছর আগে কিনছে। শাম সেটা বেমালুম অস্বীকার করলো। শামের ভাষ্য— সে এই জমি রামকে তিরিশ বছরের জন্য ইজারা দিসিলো। ইজারার মেয়াদ শেষ। কাজেই, এই জমি এখন আবার তার।
ঝগড়া মেটানোর জন্য তারা রাজ্যের তহশিল অফিসে গেলো। সেখানকার কর্মচারীরা তাদের এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে ঘুরাইতে লাগলো।
শেষমেশ এক কর্মচারীর খোঁজ পাওয়া গেলো, যে তাদের এই দলিলের সন্ধান জানে। সেও তাদের খালি চা খাওয়ায়, মিষ্টি-মধুর গল্প করে আর পরের দিন আসতে বলে।
একদিন তাদের ভাগ্যের চাকা খুললো। সেই কর্মচারী যে বিশেষ ভল্টে সব দলিল রাখা হয়েছে, সেই ভল্ট খুলে দেখালো—হাজার হাজার মাটির ট্যাবলেটে ভল্ট ভর্তি। এই খড়ের গাদায় সুঁচ খুঁজবে কে? ধরে নিলাম, খুঁজতে খুঁজতে পেয়েও পেলো। এখন এটাই যে গত তিরিশ বছরে করা লাস্ট ডকুমেন্ট, এর মধ্যে যে জমির আর হাত বদল হয়নি, এর গ্যারান্টি দেবে কে?
এই সমস্যা সমাধান করার জন্য দরকার হল ডাটা ক্যাটালগ করার। ঠিকমত ক্যাটালগ করে রাখলে দলিল খুঁজতে গিয়ে আর এই হুজ্জত করতে হত না। আর এই ক্যাটালগ করতে গিয়েই জন্ম নিল একটি বিশেষ পেশার। ব্রিটিশ আমলে আমরা যাদের কেরানী বলতাম। আজকাল বলি এক্সিকিউটিভ।
ক্যাটালগ করে রাখার একটাই সুবিধা—যখন যার ফাইল দরকার হবে, সহজেই খুঁজে পাওয়া যাবে। এতে কিছুটা সময় সেভ হচ্ছে বটে। কিন্তু তার চেয়ে বহুগুণ সময় নষ্ট হচ্ছে একই ফাইল দশ টেবিলে ক্রস চেক হয়ে যেতে যেতে। অবশ্য ব্যুরোক্রেসির মূল মটোই হচ্ছে এ্যাকিউরেসি, এফিশিয়েন্সি নয়। সেটা প্রাচীনকালের আমলাতন্ত্রই হোক আর একালের।
মিশরের ব্যুরোক্রেসির দিকে একটু তাকাই। মিশরে সাধারণ মানুষ কোন জমির মালিক ছিল না। জমির মালিক ছিল ফারাওরা। কে কোন জমিচাষ করবে, কতোটুকু ফসল নিজে রাখবে আর কতোটুকু ফারাওর দুয়ারে পাঠাবে—সব নিয়ন্ত্রণ করতো এই ফারাওরা। অবশ্যই নিজেরা এই কাজ করে হাত ময়লা করতো না। এই কাজ করতো এক শক্তিশালী ব্যুরোক্রেসি দিয়ে।
এই ব্যুরোক্রেসি ছিল অনেকটা আজকের কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর মত। প্রফিট আর প্রফিটই ছিল এদের জীবনের মূল লক্ষ। একটা গাছ কাটতেও সেসময় যথাযথ কর্ত্পক্ষের পারমিট লাগতো। পারমিট লাগতো এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে মুভ করতেও। ঠিক এরকম একটা ব্যবস্থা ছিল জারের সময় রাশিয়াতেও। সরকারের পারমিশন ছাড়া কেউ এক ফার্ম থেকে আরেক ফার্মে যেতে পারতো না। এই ধরনের অধিবাসীদের একটা নামও আছে। এদের বলা হয় Serf. Less than subject, more than slave. দাসের চেয়ে উঁচু, মানুষের চেয়ে নিচু। (আজকেও যে সাধারণ মানুষ serf দের চেয়ে খুব ভালো অবস্থায় আছে—তা বলা যায় না:P)