স্তন্যপায়ীদের সাথে আমাদের আরেকটা পার্থক্য তৈরি হয় আমরা যখন শিরদাঁড়া সোজা করে দু’পায়ে দাঁড়াতে শিখি। এই দাঁড়ানোর ফলে আমরা কিছু এ্যাডেড বেনিফিট প্পাই। দাঁড়াতে শেখায় আমরা দূর থেকেই শত্রুকে সনাক্ত করতে শিখি। সেই সাথে হাত দিয়ে পাথর ছুঁড়ে শত্রুকে ঘায়েল করতে শিখি।
এটা একটা পজিটিভ ফিডব্যাক লুপের মত। হাত দিয়ে কাজের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় হাতের শিরায় শিরায় নার্ভের পরিমাণ বেড়ে যায়। আর নার্ভের পরিমাণ বাড়তে থাকায় হাত দিয়ে আমরা আরো আরো কমপ্লেক্স কাজ করতে শিখি। পাথর ছোঁড়া ফেজ পেরিয়ে আমরা তীর-ধনুকের মত সফিস্টিকেটেড হাতিয়ার ডিজাইন করা শিখি।
কিন্তু সবকিছুরই একটা উলটো দিক আছে। দাঁড়াতে শেখার ফলে মানুষের পিঠে ভালো প্রেশার পড়ে। দেখা দেয় মেরুদন্ড ও ঘাড়ের ব্যথার মত অভূতপূর্ব সমস্যা । বলা বাহুল্য, এতো ভারী একটা মাথাকে বহন করা কিন্তু সহজ কাজ নয়। মানুষের মাথার ওজন সমস্ত শরীরের ওজনের ২-৩%। শুনে কম মনে হচ্ছে তো? কিন্তু আমাদের ভাই-বেরাদরদের সাথে তুলনা করলে বুঝবেন, এটা কতো বেশি! যেখানে গরিলার ক্ষেত্রে এর মান মাত্র ০.২% আর শিম্পাঞ্জীর ক্ষেত্রে ০.৮%।
একে তো মাথার ভার বেশি। সেই ভার বহন করা মুশকিল, তার উপর সেটা যদি দাঁড়ায়ে বহন করতে হয়। আমরা এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি দেখে ব্যাপারটা গায়ে লাগে না। কিন্তু একটু চোখ বন্ধ করে ভেবে দেখুন। এতো ভারী একটা জিনিস আপনি অনন্তকাল ধরে দাঁড়িয়ে বহন করছেন। নিজের সামর্থ্যের প্রতি একটা অন্যরকম শ্রদ্ধা চলে আসবে।
দাঁড়াতে শেখায় সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়েছে নারীদের। এর ফলে নারীদের শ্রোণীদেশ দিন দিন সরু হয়ে যাচ্ছিল। সেটা সমস্যা না। সমস্যা হল, এর ফলে বাচ্চা জন্মাবার রাস্তাও দিন দিন সরু হয়ে যাচ্ছিল। এদিকে বাচ্চাদের মাথার সাইজ জেনারেশন থেকে জেনারেশনে বড় হচ্ছে। মাথার সাইজ বাড়ছে, কিন্তু সেই মাথা বের হবার রাস্তা দিনকে দিন ছোট হচ্ছে। প্রসবকালীণ শিশু ম্ত্যুর ব্যাপকতা তাই মানব জাতির জন্য একটা বিরাট কনসার্ন হয়ে দেখা দিল।
দেখা গেলো, যেসব মা বাচ্চা জন্ম নেবার নরমাল সময়ের আগেই বাচ্চা ডেলিভারী দিচ্ছেন, তাদের বাচ্চা বেঁচেবর্তে উঠছে। দেরি করলেই মা-শিশু দু’জনই মারা খাচ্ছে। কাজেই, ন্যাচারাল সিলেকশন বলে—তাড়াতাড়ি বাচ্চা মায়ের পেট থেকে বের হওয়াই ভালো।
তাড়াতাড়ি বাচ্চা বের হতে গিয়ে আরেক সমস্যা দেখা দিল। এই শিশুদের শরীরের বেশ কিছুত গুরুত্বপূর্ণ অংশই তখনো আন্ডার-ডেভেলপড। অন্য প্রাণীদের বাচ্চারা যেখানেই জন্মের পরপরই মোটামুটি হাঁটতে-দৌড়ুতে পারে, মানব শিশু সেখানে নেহাতই বোকাচ্চো।
এতে অবশ্য আমাদের একটা লাভ হয়েছে। মা যেহেতু একা শিশুটির খাবারের সংস্থান করতে পারছে না, সেই খাবার যোগাড়ের জন্য একজন বাবা’র প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে। বায়োলজিক্যাল বাবা না, সামাজিক বাবা। যে মা ও শিশুটার জন্য বনেবাদাড়ে যুদ্ধ করে খাবার নিয়ে আসবে। আবার শিশু জন্মের পর পর মা-বাবা দু’জনের পক্ষেও অনেক সময় সেই দুর্বল শিশুটার সব প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য তাদের আশেপাশের মানুষের সাহায্য প্রয়োজন। এই সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে তাদের বন্ধুবান্ধব, পরিচিতজন। এইভাবে একটা শিশুকে মানুষ করার জন্য যে সোশ্যাল নটটা গড়ে উঠছে—তাই পরবর্তীতে গোত্র বা গোষ্ঠী গঠনে সাহায্য করবে। আর মানুষকে এগিয়ে দেবে বহুদূর।
আমরা যখন নিজেদের মানুষ বা হোমো সেপিয়েন্স হিসেবে পরিচয় দিই, তখন নিজের অজান্তে আমরা স্বীকার করে নিই যে, আমরা ছাড়াও এ প্থিবীর বুকে আরো নানা প্রজাতির মানুষ ছিল। কেননা, Homo মানে মানুষ আর Sapiens মানে জ্ঞানী। আমরা হলাম গিয়ে জ্ঞানী মানুষ। আমরা যদি জ্ঞানী মানুষ হই, তবে তো কিছু মূর্খ, জ্ঞানহীন মানুষের অস্তিত্ব্বও এ প্থিবীর বুকে ছিল। তারা তবে কই?
এই গল্পের শুরু দেড় লাখ বছর আগে। প্থিবীতে তখন রাজত্ব করছে কমসে কম ছয় রকমের মানুষ। এর মধ্যে তিন রকমের মানুষ সংখ্যায় ভারী। একদল—আমরা, মানে হোমো সেপিয়েন্সরা বসতি গড়েছি আফ্রিকার এক পূর্ব কোণে। নিয়েন্ডারথাল মানুষেরা ইউরোপে শীতের বিরুদ্ধে লড়ছে। আর এশিয়ার পূর্বকোণে হোমো ইরেক্টাস মানুষেরা সুখে শান্তিতে দিন গুজরান করে চলেছে।
আমরা মানে হোমো সেপিয়েনসরা আর আমাদের ভাই-বেরাদররা প্রত্যেকেই তখন আগুন ব্যবহার করতে শিখেছি। আমাদের মস্তিষ্কের সাইজও বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। অথচ এই মস্তিষ্ক নিয়েই আমরা আফ্রিকার এক পূর্ব কোণে পড়ে রয়েছি।
এই করে কেটে গেছে বহু বছর।
সত্তর হাজার বছর আগে একদল হোমো সেপিয়েন্স প্রথমে মধ্যপ্রাচ্যে, সেখান থেকে ইউরোপে ঢুকে পড়লো। এইখানে তাদের মোলাকাত হল নিয়েন্ডারথাল মানুষদের সাথে।
একে তো এরা ছিল আমাদের চেয়ে অধিক পেশীবহুল, অন্যদিকে এদের মস্তিষ্কও আমাদের চেয়ে সাইজে বড় ছিল। এমনকি টেকনোলজির দিক দিয়েও এরা এগিয়ে ছিল। এদের হাতিয়ার ছল উন্নতমানের। কাজেই, এরা বেটার শিকারী ছিল।
সামাজিক মূল্যবোধের দিক দিয়েও এরা আমাদের চেয়ে উঁচু মেন্টালিটির ছিল। ব্দ্ধ, অথর্বদের সেবাযত্নের কোনরকম ত্রুটি করতো না এরা। প্রত্নতাত্ত্বিকরা দিনরাত খোঁড়াখুঁড়ি করে এর সপক্ষে প্রমাণ হাজির করেছেন। তারা এমন কিছু নিয়েন্ডারথাল হাড়গোড় পেয়েছেন, যা কিনা ঐ লোকের শারীরিক ত্রুটিগস্ত হবার এবং সেই সাথে ঐ ত্রুটি নিয়েই বহু দিন বেঁচে থাকার প্রমাণ বহন করে।