ওয়েল, এই কাজটাই ফারাওরা করতো তাদের বউয়ের জন্য তার মন পছন্দ সমাধি বানিয়ে। বউ নিয়ে তারা ব্যাবিলন ঘুরতে যেতো না। মোগল সম্রাটেরা করতেন তাজমহল বানিয়ে। আমাদের তাজমহল বানানোর সামর্থ্য নেই। কাজেই, আমরা বেশি বেশি করে এক্সপেরিয়েন্স নেবার চেষ্টা করি। এই এক্সপেরিয়েন্সগুলোই আমাদের তাজমহল। সমস্ত সভ্যতাই এভাবে তাজমহল বানিয়ে গেছে। তাজমহলের রূপটা কেবল বদলেছে যুগে যুগে।
হ্দয়ের দাবি নয়, সময়ের দাবীই তাই আমরা শুনে চলেছি বারবার। সাজেকের ইতিহাস হয়তো আপনার জানা। কীভাবে সেখানকার মানুষদের উচ্ছেদ করে সাজেক বানানো হয়েছে—আপনি তার খুঁটিনাটি জানেন। কাজেই, সাজেকে যেতে আপনার মন ঠিক সায় দেয় না। এদিকে বন্ধুবান্ধবের তোলা ছবি দেখে আপনার ঘুম পাড়ানো ইচ্ছেটা আবার জেগে ওঠে। আর এটা তো জানা কথাই যে, সোশ্যাল মিডিয়া হচ্ছে কনজ্যুমারিজমের সবচেয়ে বড় চারণক্ষেত্র। আপনি গাড়ি, বাড়ি, ডিএসএলার—যাই কিনেন না কেনো, আপনাকে একটা ম্য্যণ্ডাটরি ছবি দিতেই হবে। মানুষ একটা কিছু অর্জন করে যতোটা না সুখ পায়, তার চেয়ে অনেক বেশি সুখ পায় অন্যের মধ্যে হাহাকার তৈরি করে। দিন শেষে আপনিও তাই ব্যাকপ্যাক নিয়ে সাজেকের উদ্দেশে রওনা দেন। জিত হয় কনজ্যুমারিজমের।
নিজের কথাই বলি। শাদা ইউরোপীয়রা এককালে আমেরিকার আদি অধিবাসীদের মোটামুটি নিশ্চিহ্ন করে তাদের ইমাজিনড অর্ডার তৈরি করেছে এখানে। আমরা যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, সেখানটিতেই হয়তো কোন আদিবাসী ফ্যামিলির সুখী, সুন্দর সংসার ছিল। তাদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে আমরা জ্ঞানচর্চা করে চলেছি। এই জ্ঞানটুকু থাকার পরও আমরা কিন্তু এখানে আসি। এসে অন্যদের উপদেশ দিই, ফলো ইয়োর হার্ট। যদিও আমরাও সময়ের দাবিতেই এখানে এসেছি।
সবাই যে কনজ্যুমারিজমের দাস—তা অবশ্যই নয়। এক আধজন পাগল সব জায়গাতেই থাকে, যারা কিনা হ্দয়ের দাবি শোনে। এদের মধ্য থেকেই কেউ নিউটন হয়, আর কেউ হয় কৈলাশ সত্যার্থী।
গল্পের মিশরীয় ভার্সনটা এরকম।
দেবতা থট একবার এক নতুন জিনিস আবিষ্কার করলেন। এর নাম লিখিত ভাষা। এই নিয়ে তিনি সম্রাট থামুসের কাছে হাজির হলেন। ভাবলেন, এই নতুন টেকনোলজি দেখে রাজা বেজায় খুশি হবেন। কিন্তু না! রাজা বেজার হলেন। বললেন, এই টেকনোলজি লইয়া আমরা কী করিব? এর ফলে তো মানুষ আর কিছু মনে রাখতে চাইবে না। সব পুঁথিগত বিদ্যায় পণ্ডিত হবে। আস্তে আস্তে তার স্ম্তিশক্তি লোপ পাবে।
থামুসের ভবিষ্যৎবাণী পুরোপুরি না হলেও আংশিক সত্যি হয়েছে বলা যায়। তাতে কী? টেকনোলজি এমন একটা জিনিস যাকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারে না। কোন রাজা-মহারাজাও না। মানুষ নিজ প্রয়োজনেই তাকে আপন করে নেয়। থটের লিখিত ভাষাও তাই মানুষ যাকে সভ্যতা বলে, অতি দ্রুত সেই সভ্যতার কেন্দ্রে জায়গা করে নিল।
দেবতাদের গল্প পুরাণের পাতাতেই থাক। আমরা পুরাণ ছেড়ে বাস্তবে আসি।
কবি বলেছেন, Necessity is the mother of invention. ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলে মানুষ যতো বাড়ছিলো, তাদের ফসলের ম্যানেজমেন্ট করাও ততো কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। কে কতোটুকু ফসল ফলাচ্ছে, কার কাছ থেকে কতোটুকু খাজনা নিতে হবে—বেচারা গ্রামপ্রধান তার ছোট্ট মগজ দিয়ে এই ব্যাপারগুলোর আর ট্র্যাক রাখতে পারছিলো না। যদিও পপুলার সায়েন্স আমাদের বলে, Your brain is bigger than you think.আমাদের মগজ আসলে ডাটা এ্যানালাইজ করার জন্য ভালো মাল। ডাটা স্টোর করার জন্য নেহাৎ-ই ভুষি মাল।
গ্রামপ্রধানের এই দুর্দিনে এগিয়ে এলেন কিছু সুমেরীয় জিনিয়াস। কোথা থেকে কীভাবে ঠিক জানা যায় না, তবে লিখিত ভাষার উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে তারা এই সমস্যার আপাত সমাধান দিলেন। সেটা আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগের কথা।
সুমেরীয়রা দু’রকম চিহ্ন ব্যবহার করতো। একটা ছিল সংখ্যাভিত্তিক চিহ্ন।
১, ১০, ৬০, ৬০০, ৩৬০০, ৩৬০০০—এই বিশেষ সংখ্যাগুলোর জন্য তাদের আলাদা আলাদা চিহ্ন ছিল। সংখ্যাগুলো কি চেনা চেনা লাগছে? লাগারই কথা। আজ আমরা যে সময় গণনা করি—তা তো এই ৬ ভিত্তিক সংখ্যার বদৌলতেই। এমনকি আমাদের দিনও হয় ২৪ ঘণ্টায়। সেও ৬ দ্বারা বিভাজ্য। আর এক ধরনের চিহ্ন দিয়ে বোঝাতো মানুষ, পশুপাখি—এইসব।
মানুষ, পশুপাখি, ঘরবাড়ির ছবি দিয়ে ওরা যে ভাষা কাঠামো তৈয়ার করেছিল—একে বলে পিকটোগ্রাম। আমাদের আজকের বর্ণমালার বিবর্তন খেয়াল করলে দেখবেন, প্রায় প্রতিটা বর্ণই এসেছে কোন না কোন ছবি থেকে। ছবি মা, বর্ণ তার দুষ্টু সন্তান।
A এর বিবর্তনটা লক্ষ করুন। শুরুতে A দেখতে ছিল ষাঁড়ের মাথার মত। আস্তে আস্তে সেটা বিবর্তিত হতে হতে আজকের A তে এসে ঠেকেছে। (ছবি-১)। একুইভাবে B এসেছে কুঁড়েঘর থেকে (ছবি-২)। C উটের কুঁজের বিবর্তিত রূপ। আর O চোখের সংক্ষিপ্ত ভার্সন।
বর্ণগুলো না হয় বুঝলাম ছবি থেকে এসেছে। বর্ণগুলোর উচ্চারণ কোথ থেকে এসেছে? এসেছে শব্দ থেকে। বাবা আদামকে খোদা দায়িত্ব দিয়েছিলেন সকল পশুপাখির নাম দেবার। উনি তাদের কী নাম দিয়েছিলেন আমি জানি না। তবে ফিনিশীয়রা কী নাম দিয়েছিল—সেটা জানা যায়। ফিনিশীয়রা ষাঁড়কে বলতো aleph. সেই আলেফ থেকেই গ্রীক আলফা বা আরবী আলিফের জন্ম। যা কিনা আজকের A. ঘরকে ওরা বলতো beth. গ্রীক বেটা’র সাথে কোন মিল পাচ্ছেন কি? কিংবা আরবি বা আর ইংরেজি b এর সাথে? বেথেলহেমের নাম তো সবাই শুনেছেন। প্রভু যীশুর জন্মস্থান। bêth আর lehem—এই দুটি শব্দের মিলনে মেথেলহেমের জন্ম। Bêth মানে তো এখন বুঝতেই পারছেন ঘর। আর lehem মানে রুটি। বেথেলহেম হল সেই শহর বা ঘর যেখানে রুটি বানানো হত।