একটা দেশ বা জাতি কতোটুকু সভ্য—তার প্রমাণ হয়, তার পাবলিক টয়লেট দেখে আর সে তার অভিজাতদের অন্যায়ের বিচার কতোটুকু করতে পারে—সেই মেট্রিক দিয়ে। আমাদের দেশে যেমন শুধু সংবিধানেই লেখা সবার জন্য একই আইন। বাস্তবে, অভিজাতদের জন্য এক আইন, আর সাধারণের জন্য আরেক। এদেশে একজন আইজি’র ছেলে যেমন বড় হতে হতে জেনে যায়, সে যে কারো উপর গাড়ি উঠিয়ে দিতে পারবে। ফুতপাতে ঘুমন্ত মানুষকে মেরে ফেললেও কেউ কিছু বলবে না। এই নলেজ কিন্তু সে সংবিধান পড়ে পায়নি, আশপাশটা দেখে পেয়েছে। আগেকার দিনে এই নলেজটাই অনেক খোলাখুলি সংবিধানে বলা থাকতো। সেদিক দিয়ে বিচার করলে, ব্যাবিলনের মানুষকে ভাল-মন্দ জাজ করা আপনার বিবেচনা, কিন্তু তারা যে অনেক সৎ ছিল—সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
ব্যাবিলনের সংবিধানের সবটাই যে খারাপ ছিল—তা নয়। সমাজের প্রতি যেন ইনডিভিজুয়ালের দায়িত্ববোধ তৈরি হয়—তার জন্য বেশ কড়া কিছু নিয়ম-কানুন ছিল সেই বিধানে। ধরা যাক, এক ইঞ্জিনিয়ার আপনার বাড়ি তৈরি করে দিল। কিছুদিন পর সেই বাড়ি ধ্বসে গিয়ে সবাই মারা গেল। আইনমতে, সেই ইঞ্জিনিয়ারের তখন ফাঁসি হবে। আজকের পারস্পকেটিভে এটা লঘু পাপে গুরুদণ্ড হলেও সেকালের দ্ষ্টিতে এটা ছিল ভয়ানক অপরাধ। আপনি যখন কারো জন্য কিছু নির্মাণ করছেন, তখন সেই বাড়িতে অবস্থানকালীন তার জানের জিম্মাদারিও আপনি নিচ্ছে। সেই জান বিগত হওয়া মানে আপনারও আর বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই।
কেবল সমাজের প্রতি ইনডিভিজুয়ালের নয়, ইনডিভিজুয়ালের প্রতি সমাজেরও একটা দায়িত্ব আছে। একটা আইন ছিল এমন—কোন একটা পাড়ায় কোন বহিরাগত এসে ছিনতাইয়ের শিকার হলে পাড়ার সবাই মিলে তাকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবে। এটা হল পাড়ায় ছিনতাইকারী পোষার শাস্তি।
কোন বিধানই পারফেক্ট নয়। হামুরাবিরটাও না। তবু সেই সমাজে বিধান আর বিধানের বাইরের জীবনটায় দূরত্ব অনেক কম ছিল। সভ্যতার চাকা ঘুরতে ঘুরতে সেই দূরত্ব কেবল বেড়েই চলেছে। বেড়েই চলেছে।
আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত স্বপ্নগুলোও আসলে ‘ইমাজিনড অর্ডার’-ই ঠিক করে দেয়।
পপুলার কালচার আমাদের বলে—Follow your heart. হ্দয়ের দাবি শোনো। এখন এই হ্দয়ের দাবি তো শূন্য থেকে ভেসে ওঠা কোন চাহিদা নয়। হাজার বছরের সভ্যতায় এই দাবিগুলো তৈরি হয়েছে। ঊনিশ শতকের রোমান্টিসিজম আর বিশ শতকের কনজ্যুমারিজম সেই পালে আরো হাওয়া লাগিয়েছে। আমরা নিজেদের যতোই বিদ্রোহী, বিপ্লবী বা হাওয়া বিরোধী দাবি করি না কেন, দিন শেষে আমরা সেই হাওয়ার সাথেই চলি।
আপনার হয়তো ছুটিছাটায় খুব বেড়ানোর শখ। এই শখ কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষদের ছিল না। এক আলফা শিম্পাঞ্জী গায়ের জোর খাটিয়ে আরেক দল শিম্পাঞ্জীর বাসায় দাওয়াত খেতে যেতো না। আমাদের মিশরীয় দাদুরা অবসরে কক্সবাজার না গিয়ে বানাতেন পিরামিড। আর মমি। এই কক্সবাজার যাওয়ার কালচারটা শুরু করে মূলত রোমানরা। রোমান সাম্রাজ্যের শেষ দিকে অভিজাতরা তাদের সামার কাটানোর জন্য বেছে নিত মিশরকে। রোমানদের সেই কালচারই আজকের বিরাট পর্যটন শিল্পে রূপ নিয়েছে।
রোমান্টিসিজম আমাদের বলে, জীবনটাকে যতো পারো, উপভোগ করে নাও। যতো বেশি পারো, অভিজ্ঞতা অর্জন করে নাও। আমাদের তাই সব রকমের বই পড়ে দেখতে হবে, সব রকমের মুভি চেখে দেখতে হবে, সব রকমের খাবারের স্বাদ নিতে হবে, সব রকম রিলেশনশিপের মজা নিতে হবে, আর যতো যতো দর্শনীয় স্থান আছে—সবগুলো দেখে মরতে হবে।
কেন ভাই? কেন আমাকে সব কিছুই করতে হবে? গিভ মি এ্যা ব্রেক।
কিন্তু রোমান্টিসিজম আপনাকে ব্রেক দিলেও কনজ্যুমারিজম আপনাকে ব্রেক দিবে না। সে সারাক্ষণ আপনার চোখের সামনে এই সবের বিজ্ঞাপন নিয়ে হাজির হতে থাকবে। Ten things you must do before you get 30, ten places you must visit before you die, ten girls/boys you must date before you marry—এই সবই হচ্ছে পুঁজিবাদের টোপ। পত্রিকা ম্যাগাজিনের গণ্ডি ছাড়িয়ে সেই টোপ চলে এসেছে আপনার মুঠোফোনে। দিনরাত এগুলো দেখে আপনিও এক সময় নিজের বাকেট লিস্ট টৈরি করা শুরু করেন। কনজ্যুমারিজম আপনাকে যেই ছাঁচের মানুষ বানাতে চাচ্ছে, আপনি নিজের অজান্তে সেই ছাঁচের মানুষে পরিণত হচ্ছেন। যদিও মনে মনে ভাবছেন—আমার হ্দয় আমাকে এটা বলছে। সত্যটা হচ্ছে এই যে, হ্দয় আপনাকে বলছে না। বলছে পুঁজিবাদ। আমি আপনি তাতে সাড়া দিচ্ছি কেবল।
কনজ্যুমারিজমের কাজই হচ্ছে প্রোডাক্ট বিরক্রি করা। আর অভিজ্ঞতা হচ্ছে সবচেয়ে বড় প্রোডাক্ট। আপনার কানের কাছে এসে দিনরাত বিড়বিড় করা হবে—নায়াগ্রা ফলস না দেখলে আপনার জীবন ব্থা। কিংবা “প্থিবীতে দুই রকমের মানুষ আছে–এক, যারা নায়াগ্রা ফলস দেখসে। আর এক, যারা তা দেখেনি।” আপনি নিশ্চয়ই দুই নম্বর দলে পড়ে থাকতে চাইবেন না। প্রিয় মানুষদের কম সময় দিয়ে হলেও আপনি এক্সট্রা খেটে সেই অভিজ্ঞতাটা কিনতে চাইবেন।
আপনি হয়তো এই মধ্যবিত্তের দলে পড়েন না। আপনি পড়েন বিত্তবানদের দলে। আপনার সাথে আপনার বউয়ের রিলেশনশিপ ক্রাইসিস চলছে। তো এই ক্রাইসিস মেটানোর জন্য আপনি তাকে লন্ডন বা প্যারিস নিয়ে গেলেন। অথচ রাত করে বাড়িতে না ফিরে বউকে সময় দিলেই হয়তো এই ক্রাইসিস মেটানো যেত। কিন্তু পুঁজিবাদের চাকা তো তাইলে বন্ধ হয়ে যাবে। পুঁজিবাদ চাইবে, আপনাদের মধ্যে বারংবার ঝগড়া হোক। আর আপনারা বেশি বেশি করে হিল্লিদিল্লি করুন।