পরের দিন যখন কেএফসিতে মুরগির রান চিবাবেন কিংবা মোস্তাকিমে গরুর শিকে মুখ ডুবাবেন, তখন বেচারারা আমাদের সামান্য সুখের জন্য যে প্যাথেটিক জীবনটা যাপন করে চলেছে, তার জন্য একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেও ফেলতে পারেন।
০৪. হামুরাবির সংবিধান
হামুরাবির সংবিধানকে বলা যায় পৃথিবীর প্রথম সংবিধান।
খ্রিস্টপূর্ব ১৭৭৬ সালের কথা। ব্যাবিলন তখন প্থিবীর সবচেয়ে জমজমাট সাম্রাজ্য। ইরাক, ইরান আর সিরিয়া মিলে এর বিস্ত্তি। ব্যাবিলনের সবচেয়ে বিখ্যাত সম্রাট ছিলেন হামুরাবি। না, ইনি আকবরের মত দীর্ঘ সময় রাজত্ব করছেন বলে বিখ্যাত নন। কিংবা আলেকজান্ডারের মত অর্ধেক প্থিবী জয় করার জন্যও বিখ্যাত নন।
তার খ্যাতির পেছনে লুকিয়ে আছে একটা কোড যে কোড তার নাম বহন করে চলেছে। এই কোডে সেকালের সমস্ত আইন কানুন লেখা আছে। এই আইন এতোই প্রভাব বিস্তারকারী ছিল যে এর পরের যুগের শাসকেরাও এটা ফলো করে গেছে বহুদিন। কী এমন আইন যা মানুষ যুগ যুগ ধরে মানুষ অন্ধের মত অনুসরণ করে গেছে?
সংবিধানের ভেতরে একটু চোখ বুলানো যাক। তাহলেই রহস্যটা ক্লিয়ার হবে।
সংবিধানের শুরু হয়েছে স্রষ্টার নাম নিয়ে। আনু, ইনলিল আর মারডুক—সেকালের তিন দেবতা। বলা হচ্ছে—দেবতারা হামুরাবিকে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের জন্য ধরাধামে পাঠিয়েছেন। এটা শাসকদের একটা কমন ফিচার। শাসকেরা যেই আইনই প্রণয়ন অরে, সেটাকে হায়ার অথরিটির’ নাম দিয়ে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করে। সেই হায়ার অথরিটি হতে পারে কোন ঈশ্বর বা শ্রদ্ধেয় কোন পূর্বপুরুষ। কিছু আইন এমনঃ
-এক লোক যদি আরেক লোকের চোখ উপড়ে ফেলে আর দুইজনই যদি অভিজাত হয়, তবে অপরাধীরও চোখ উপড়ে ফেলা হবে।
(চোখের বদলে চোখ—এই ব্যাপারটা এসেছে সম্ভবত হিব্রু ল থেকে। ইহুদীরা বিশ্বাস করতো, তারা খোদার ‘চজেন পিপল’। প্রতিটা ইসরায়েলীকেই খোদা পরম যত্নে তৈরি করছেন। কাজেই এক ইহুদী যদি আরেক ইহুদীর চোখ উপড়ে ফেলে, সেটা যতোটা না ঐ মানুষটার বিরুদ্ধে অন্যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি খোদার বিরুদ্ধে অন্যায়। ফিলোসফিটা এমন—খোদা এতো কষ্ট করে এমন একটা জিনিস তৈরি করেছেন, তুমি কোন ছার যে তা নষ্ট করবা?)
-এক অভিজাত যদি এক সাধারণ মানুষের চোখ উপড়ে ফেলে, তবে তার ৬০ ভরি রৌপ্য জরিমানা দিলেই চলবে।
-এক অভিজাত যদি এক দাসের চোখ উপড়ে ফেলে, তবে সেই দাসকে যেই দামে কেনা হইসে, তার অর্ধেক জরিমানা হিসেবে দিলেই চলবে।
-এক অভিজাত পুরুষ যদি এক অভিজাত নারীকে গর্ভবতী করে ফেলে আর কোন কারণে সন্তানটি যদি মারা যায়, সেটা গর্ভাবস্থায় হোক কিংবা প্রসবের সময়, তবে তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে দশ ভরি রৌপ্য দিলেই চলবে। আর যদি কোন কারণে মহিলাটি মারা যায় তবে শাস্তি হিসেবে সেই লোকের কন্যাসন্তানটিকে হত্যা করা হবে।
-একই ঘটনা যদি এক অভিজাত পুরুষ এক সাধারণ নারীর সাথে ঘটায়, তবে জরিমানা হিসেবে দিতে হিবে আগের অর্ধেক। মানে পাঁচ ভরি রৌপ্য। আর সেই মহিলা যদি মারা যায়, তবে আরো তিরিশ ভরি রৌপ্য দিলেই মাফ। অভিজাত বীরপুঙ্গবের কন্যাসন্তানটি এ যাত্রায় বেঁচে গেল।
-ঠিক এই ঘটনাই এক দাসীর সাথে ঘটলে অভিজাত পুরুষটিকে দিতে হবে যথাক্রমে দুই ভরি আর বিশ ভরি রৌপ্য।*
একটা অদ্ভূত নিয়ম খেয়াল করসেন নিশ্চয়ই। হামুরাবির সংবিধান অনুযায়ী পুত্র-কন্যা হচ্ছে বাপ-মা’র সম্পত্তি। অভিজাত বাবা পাপ করলে তার দায় ভোগ করতে হবে তার নিরপরাধ কন্যাটিকে। নারীদের জন্য প্থিবীটা সবসময়ই কঠিন ছিল। অন্তত লিখিত ইতিহাস যতোদিনের, ততোদিন তো বটেই।
কঠিন ছিল সাধারণ মানুষের জন্যও। স্পষ্টতই, সেকালে অভিজাত মানুষের জন্য এক রকম আইন ছিল, আর সাধারণ মানুষের জন্য এক। সকল মানুষ যে সমান—এই ধারণা আসেই নি তখনো।
এই ধারণার প্রয়োগ আমরা দেখি আরো বহু বছর পর ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার সংবিধানে। ইংল্যান্ডের রাজার শাসনে অতিষ্ঠ একদল ভদ্রলোক নিজেদের জন্য এক রকম আইন তৈরি করে। সেখানে দ্প্তকণ্ঠে ঘোষনা করা হয়—সকল মানুষ সমান। যদিও মানুষ বলতে তারা অঘোষিতাভেব ‘শাদা মানুষ’-কেই বোঝাচ্ছিল। কালো মানুষেরা তখনো সিলেবাসের বাইরে ছিল। সকল মানুষ সমান—এই বোধটা আসতে আরো দুশো বছর লেগে যায়। দরকার হয়ে অনেক রক্তের। কালো মানুষের রক্তের।
কিন্তু আসলেই কি সব মানুষ সমান? আমরা কি বায়োলজিক্যালী সমান? উহুঁ। অর্থনৈতিকভাবে সবাই একই শ্রেণীতে পড়ি? তাও না। তবে কিভাবে মানুষ সমান হয়? আইন করে সকাল মানুষকে সমান ঘোষণা করারই বা দরকার কী? এর পেছনে কি কারো স্বার্থ আছে? আইনের জন্মই বা কেন?
মনে রাখতে হবে, আইনের জন্ম কিন্তু অভিজাতদের হাতে। সাধারণ মানুষ তৈরি করে প্রথা, আর অভিজাতেরা আইন। গল্প যেমন মিথ তৈরি করে, আইনও দিনে দিনে একটা মিথ তৈরি করে। প্রকাশ্যে ধূমপান করলে পঞ্চাশ টাকা জরিমানা—এই আইনের কথা মনে আছে? এর ঠুনকোতা আমাদের আরবান কালচারে অনেক অনেক গল্প তৈরি করেছিল। নিউয়র্কে একটা মেয়ে চাইলেই প্রকাশ্যে টপলেস হতে পারবে। কিন্তু আইনত সেই টপলেস ছবি কোথাও কমার্শিয়ালী ব্যবহার করতে পারবে না। নিউয়র্কের জনসমাজেও হয়তো এই আইন নিয়ে নানা চটুল গল্প চালু আছে।
গল্প যেই কাজটা করে, আইনও ধীরে ধীরে সেই কাজটাই করে। একটা ইমাজিনড রিয়েলিটির জন্ম দেয়। জন্ম দেয় একটা অর্ডারের। সাধারণ মানুষের উপর ছড়ি ঘুরাবার জন্য এই অর্ডারটা দরকার অভিজাতদের।আইন ছাড়াও কিন্তু আমরা বেশ চলতে পারতাম। সেটা খুব ক্ষুদ্র গণ্ডিতে। ১০০ কি ১৫০ মানুষের দলে। আরো বড় ফেইজে যখন কো-অপারেশনের প্রয়োজন হয়, তখনই দরকার হয় আইন। আইনের দণ্ডটা যদিও অভিজাতদের হাতে, একটা বড়সড় সমাজকে ফাংশনাল রাখতে আইনের আসলেই কোন বিকল্প নেই।