স্ত্রী ভেড়াদের দশা হল আরো করুণ। যেগুলো একটু শুকনা-পাতলা ছিল, সেগুলোকে চোখ বন্ধ করে মেরে ফেলা হল। ফলে, খালি মোটা আর থলথলে ভেড়াগুলোর জিনই এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে বাহিত হবার সুযোগ পেল। ফলাফল, ভেড়া দিনকে দিন ফুলতে থাকলো আর মানুষের বশ হতে লাগলো।
এর আগে মানুষ যেখানেই গেছে, সেখানকার ডেমোগ্রাফিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। অবশ্যই নেগেটিভ পরিবর্তন। এই প্রথম মানুষ খোদ বিবর্তনের গতি পালটে দিতে শুরু করলো। বিবর্তনকে ব্যবহার করতে লাগলো নিজের দরকার মত।
দশ হাজার বছর আগেই মানুষ গরু, ছাগল, শুয়োর, ভেড়া আর মুরগিকে নিজেদের বশ করে ফেলে। গোটা প্থিবীতে তখন তাদের সংখ্যা ছিল কয়েক মিলিয়নের মত। আজ এক মুরগিই আছে পঁচিশ বিলিয়নের বেশি। তার মানে প্রতিটা মানুষের জন্য প্রায় চারটা করে মুরগি। আর গরু-ছাগল, শুয়োর-ভেড়া তো আছেই বিলিয়নখানেকের বেশি।
বিবর্তনের দ্ষ্টিকোণ থেকে দেখলে, মুরগি কিন্তু মানুষের চেয়ে অনেক বেশি সফল। বিবর্তনের সানগ্লাস দিয়ে দেখলে, যে জিন নিজেকে যতো বেশি ছড়িয়ে দিতে পেরেছে,সে ততো সফল। সেই হিসেবে মুরগি ইতিহাসের সফলতম প্রাণীদের একটি।
ওয়েইট!
ইভোল্যুশনারী সাকসেস আর ইনডিভিজ্যুয়াল সাকসেস এক জিনিস না।
এই ইভোল্যুশনারী সাকসেস অর্জনের জন্য এদের বিরাট মূল্য দিতে হয়েছে। যে কারণে এদের ব্যক্তিগত জীবন বলতে কিছুই নাই এখন।
বনমুরগির গড় আয়ু ছিল সাত থেকে বার বছর। গবাদি পশুর ক্ষেত্রে সেটা বিশ থেকে পঁচিশ বছর। এতোটা হয়তো এরা বাঁচতো না। কিন্তু তবু এদের জীবনেও একটা আশা ছিল, সম্ভাবনা ছিল এতোগুলো দিন, মাস, বছর প্থিবীর রঙ, রূপ, রস উপভোগ করার। আজ সেই সম্ভাবনাকে আমরা গলা টিপে মেরে ফেলেছি। আজ একটা মুরগির গড় আয়ু কয়েক সপ্তাহ, বড়জোর কয়েক মাস।
যে মুরগি ডিম পাড়ে, আর যে গাভী দুধ দেয়—এদের হয়তো কিছু বেশিদিন বেঁচে থাকতে দেয়া হয়। কিন্তু কিসের বিনিময়ে? চরম অপমান আর অসম্মানের বন্দী জীবনের বিনিময়ে।
একটা তরুণী গাভীর পারস্পেক্টিভে একবার চিন্তা করুন। তারও তো ইচ্ছা হতে পারে ভালো দেখে একটা গরুর সাথে প্রেম করতে। দু’জনে মিলে বাচ্চা জন্ম দিতে। তারপর সেই বাচ্চাকে আদর-যত্ন করে বড় করতে, দুধ খাওয়াতে।
অথচ আমরা তার প্রতিটা অধিকারই কেড়ে নিচ্ছি নিজেদের স্বার্থ হাসিলে। সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়েছে পুরুষগুলোকে। এরা যখন আমাদের আর কাজে লাগে না, তখন এদের খোঁজা করে ফেলা হয়। সবচেয়ে মারমুখী পুরুষটাও তখন মানুষের দাসানুদাস হয়ে যায়। আর দশটা প্রাণীর মত এদের যে একটা সামাজিক জীবন ছিল, সেই জীবন আমরা পুরোপুরি কেড়ে নিয়েছি নিজেদের সুখ-সুবিধা আদায়ে।
নিজেদের সুখ-সুবিধার জন্য মানুষ কতোদূর নামতে পারে, তা কিছু উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। নিউ গিনির সমাজের কথা বলি। এদের সমাজে একটা মানুষ কতোটুকু সম্পদশালী—তা যাচাই করা হত তার শুয়োর সংখ্যা দিয়ে। তো শুয়োরগুলো যেন পালাতে না পারে, সেজন্যে তারা শুয়োরের নাক কেটে দিত। একে তো শুয়োরগুলো নাকের ব্যথায় প্রচণ্ড কষ্ট পেত, তার উপর ঘ্রাণ শুঁকতে না পারায় নিজে নিজে খাবারও খুঁজতে পারতো না। ফলাফল, মানুষের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া।
আরেকদল তো ছিল একটেল এক ধাপ এগিয়ে। এরা শুয়োরের চোখ জাস্ট কানা করে দিত। স্বাধীনতার তো প্রশ্নই আসে না।
সবচেয়ে নিষ্ঠুর আচরণ করা হয় গরু-ছাগলের সাথে। গরু-ছাগল তো আর এমনি এমনি দুধ দেয় না। কেবল বাচ্চা হলেই দুধ দেয়। তো প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ বাচ্চা জন্ম নেবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাচ্চাগুলোকে মেরে ফেলতো। যতোটুকু দুধ দোয়ানোর—দুইয়ে নিত। তারপর মা বেচারীকে আবার প্রেগন্যান্ট করে ছাড়তো। একটা গরু হয়তো পাঁচ বছর বাঁচে। দেখা যায়, বাচ্চা জন্মের দুই কি চার মাসের মধ্যে তাকে আবার প্রেগন্যান্ট করে ফেলা হয়। ভদ্রমহিলা তার জীবনের অধিকাংশ সময়ই এভাবে প্রেগন্যান্ট অবস্থায় কাটিয়ে দেন। কেবল দুধের সর্বোচ্চ সাপ্লাই নিশ্চিত করার হন্য।
নিষ্ঠুরতার এখানেই শেষ নয়। সবচেয়ে বড় নিষ্ঠুরতা আমরা সবাই কমবেশি গ্রামে গিয়ে স্বচক্ষে দেখেছি। বাছুরটাকে মা গরুর কাছে নিয়ে আসা হয়। সে দুধ খাওয়া শুরু করলে ই তাকে মায়ের বুক থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। মা-শিশু—দু’জনেই এতে প্রবল বাধা দেয়। কিন্তু মানুষের হিংস্রতার সামনে সেই বাধা কিছুই নয়। ভীব দেখুন তো, এই একই কাজ মানুষের সাথে কেউ করলে আমাদের কেমন লাগতো?
এতো গেল পরিচিত দ্শ্যের কথা। অপরিচিত দ্শ্যের কথা বলি।
একটা গোষ্ঠী আছে যারা ভেড়ার বাচ্চা মেরে তার মাংস খেয়ে চামড়াটা রেখে দিত। সেই চামড়া দিয়ে ভেড়ার একটা অবয়ব তৈরি করতো। ভেড়ার সেই অবয়ব মা ভেড়ার কাছে আনলে তার শরীরে দুধ আসতো। আরেকটা টেকনিক হচ্ছে বাছুরের মুখে শিং এর মত ধারালো কিছু দিয়ে ঢেকে রাখা। বাছুর তখন দুধ খেতে চাইলে মা নিজেই তাকে ব্যথায় সরিয়ে দিবে। সাহারা মরুভূমির লোকজন উটের বাচ্চার নাক আর উপরের ঠোঁট কেটে রাখতো। যেন বেশি দুধ খেতে না পারে। অল্পতেই হাঁপিয়ে যায়।
প্থিবীর ইতিহাস আসলে ভালবাসার ইতিহাস নয়। অন্যায়ের ইতিহাস। সবচেয়ে বড় অন্যায়টা বোধ হয় আমরা করেছি আর করেই চলেছি এই গ্হপালিত পশুপাখিদের সাথে। প্থিবীটা তাদের কাছে একটা জেলখানা বৈ তো কিছু নয়। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, এই অন্যায়ের জন্য আমাদের ভেতরে কোন অনুশোচনাও নেই। সম্ভবত, ধান-গম আমাদের যেভাবে বুনো মানুষ থেকে ঘরবন্দী মানুষে পরিণত করেছে, আমরা তারই প্রতিশোধ নিয়েছি গরু-ছাগল আর মুরগির উপর। তাদের ঘরবন্দী করে। স্বাধীন জীবন কেড়ে নিয়ে।