সমস্যার এইখানেই শেষ না। প্থিবীতে সবসময়ই এমন কিছু মানুষ ছিল যারা নিজেরা কোন কাজ করতো না। অন্যের পরিশ্রমে ভাগ বসিয়ে নিজেদের রুটিরুজি করতো। ছোট পরিসরে এদের আমরা সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ বলি। আর বড় পরিসরে আদর করে বলি সরকার, পুলিশ কিংবা আর্মি। আর এটা তো জানা কথাই যে, সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসীই দিনশেষে সম্রাট হন।
সে যাই হোক, ক্ষকের এই ফসলে বাইরের মানুষ এসে আক্রমণ চালাতো। বলতো, আমাদের ভাগ দাও। অবশ্যই মুখের ভাষায় না, অস্ত্রের ভাষায়। এদের প্রতিহত করার জন্য ক্ষকদের একটা ইউনিটকে, কখনো বা গোটা ইউনিটকেই যুদ্ধবিদ্যার প্র্যাকটসিটা চালিয়ে যেতে হত। দিনে চাষবাস করো, আর রাতের বেলা ফসল পাহাড়া দাও। এই এক্সট্রা খাটনির জন্য তারা কোন ওভারটাইমও পেত না। তাদের জীবনটা একেবারে গেবন হয়ে গেলো।
ক্ষি মানুষকে যে লাক্সারির স্বপ্ন দেখিয়েছিল, সময়ে সেটা নির্মম ফাঁদে পরিণত হল। ক্ষি ছিল মানব ইতিহাসের প্রথম ফাঁদ। সেই যে মানুষ ফাঁদে পা দিল, এরপর থেকে একটার পর একটা ফাঁদে পড়তেই লাগল। ক্ষি তাও যতোটা না বিপ্লব, তার চেয়ে বেশি ধোঁকা হয়ে দেখা দিল মানুষের জীবনে। আশীর্বাদ নয়, দেখা দিল অভিশাপরূপে। কথা হল, এতো কিছুর পরেও মানুষ ক্ষি ছেড়ে আবার শিকারী জীবনে ফিরে গেলো না কেন?
কারণ, এই বদলগুলো ঘটেছে খূব ধীরে। ধীরে মানে এখনকার মত দশ-বিশ বছরে না। এক হাজার বছরে হয়তো খুব সামান্য একটা পরিবর্তন ঘটেছে। পরের প্রজন্মগুলো এই ধারাকে একটু একটু করে এগিয়ে নিয়ে গেছে। দশ হাজার বছর আগে মানুষ যখন পুরোপুরি ক্ষিতে থিতু হয়, এর সমস্ত ভাল আর মন্দ নিয়ে—ততোদিনে মানুষ ভুলেই গেছে যে তারাও এক সময় শিকারী ছিল। চাইলেও আর পিছু ফেরার সুযোগ তখন নেই।
ইতিহাসের নিয়মই হচ্ছে এই যে, মানুষ একবার একটা লাক্সারিতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে এক সময় সেটাকে মৌলিক চাহিদা বলে মনে করে। আমাদের দাদা-নানা রা টেলিভিশন ছাড়াই চলেছেন। আমাদের বাবা-মা’র কাছে সেটা ছিল নেসেসিটি। আবার আমাদের বাবা-মা রা মোবাইল ফোন ছাড়াই দিব্যি প্রেম করেছেন। বন্ধু বান্ধব, আত্নীয় স্বজনের সাথে যোগাযোগ রেখেছেন। আর আমরা মোবাইল ছাড়া নিজেদের অস্তিত্বই কল্পনা করতে পারি না। একদিন ভার্সিটিতে মোবাইল না নিয়ে এলে মনে হয়, আমার অস্তিত্ব বুঝি নাই হয়ে গেছে প্থিবীর ময়দান থেকে।
ইতিহাসের প্রতিটা ধাপই মানুষের সাথে এই ছলনা করেছে। শুরুতে সে একটা সুখী, সুন্দর, আরামদায়ক জীবনের লোভ দেখিয়েছে। পরে ঠিকই তাকে আগের মতই কিংবা আগের চেয়েও কষ্টসাধ্য একটা জীবনের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
কম্পিউটার আবিষ্ক্ত হয়েছিল বড় বড় ক্যালকুলেশন নিমেষে করে ফেলার জন্য। সোজা কথায়, মানুষের জীবনকে সহজ করার জন্য। আসলেই কি তাই হয়েছে? মানুষ আগে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করতো। বাসায় এসে বউ-বাচ্চা নিয়ে হুমায়ূন আহমদেরে নাটক দেখতো। আজ তার ক্যালকুলেশন সহজ হয়েছে, কিন্তু জীবন হয়ে গেছে কঠিন। আজ সে সে এগার-বারো ঘণ্টা কাজ করেও কুলাতে পারে না। না পারে বসকে খুশি করতে, না পারে বউকে খুশি করতে।
ই মেইল বা টেক্সটের কথাই ধরি না কেন! ইমেইলের আগের যুগে মানুষ মানুষকে চিঠি লিখে খোঁজখবর করতো। প্রতিটা বাক্য, প্রতিটা শব্দ খুব চিন্তা করে লেখা হত। ভালবাসা দিয়ে লেখা হত। এখন সেই কাজই অফিশিয়ালি করা হয় মেইল দিয়ে আর আনঅফিশিয়ালী টেক্সট, ফেসবুক আর হোয়াটসএ্যাপের মাধ্যমে। প্রশ্ন হল, ই-মেইল আমাদের জীবনে সুখ নিয়ে আসছে কিনা। উত্তর আবারো না। আমাদের দিনের একটা বড় অংশ কেটে যায় আজাইরা ইমেইল সাফ করতে। আর গ্রামীনফোনের মেসেজ তো আছেই!
সেকালেও হয়তো দু’একজন লোক ছিল, যারা টেকনোলজিকে অস্বীকার করেছিল। ক্ষিকাজে না লেগে শিকারী যুগেই পড়ে রইলো। এ যুগেও হয়তো আছে তেমন। ফেসবুক বা মোবাইল ইউজ করে না। হয়তো লাখে একজন। কিন্তু আছে। সমস্যা হল, টেকনোলজির নিয়মই হচ্ছে এই যে তার সমস্ত অসুবিধা নিয়েই অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাবে। সাময়িক লাক্সারির টোপ দেখিয়ে মানুষকে ফেলে দিবে বিরাট ট্র্যাপে। মানুষের জীবনকে করে তুলবে কঠিন থেকে কঠিনতর।
গুরুজনেরা তো আর শুধু শুধু বলেননি,, যায় দিন ভালো,আসে দিন খারাপ।
শিকারী মানুষের মধ্যেও কিছু ইন্টার্নাল হিসাব-নিকাশ ছিল।
তারা যখন শিকারে বেরোতো, চোখের সামনে যা পেত, তাই শিকার করতো না। হয়তো তারা ভেড়া শিকারে বেরোলো। খুঁজে খুঁজে তারা বয়স্ক আর বুড়ো-ধাড়িগুলোকেই শিকার করতো। অল্প বয়স্কগুলোকে আপাতত ছেড়ে দিত। এইটুকু কমন সেন্স তাদের ছিল, যুবতী ভেড়াগুলোকে মেরে ফেললে পরবর্তীতে নতুন ভেড়া তারা পাবে কই?
এই সিলেক্টিভ শিকারে তাদের লাভই হচ্ছিল। কিন্তু বাঘ-সিংহের যন্ত্রণায় এই লাভ দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছিল না। বাঘ-সিংহ এসে ভেড়া খেয়ে ফেললে মানুষ খাবে কী? মানুষ তখন নিজে থেকে এদের প্রটেকশন দিতে আরম্ভ করলো। একটা ঘের দেয়া এলাকায় তাদের আটকে তাদের সিকিউরিটি নিশ্চিত করলো।
কিন্তু সিকিউরিটি-ই তো জীবনের সব কিছু নয়। স্বাধীনতা বলেও একটা জিনিস আছে। কাজেই সব ভেড়াই মানুষের বশ্যতা স্বীকার করলো না। কিছু পুরুষ ভেড়া ছিল, যেগুলো খুবই এ্যাগ্রেসিভ। মানুষের কথা শুনতেই চাইতো না। মানুষ সেগুলোকে অল্প বয়সেই মেরে ফেললো। দলের বাকিদের শিক্ষা দিয়ে দিল যে বেশি তেড়িবেড়ি কলে তাদেরও এই অবস্থা হবে।