মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ যে আগে গম খেতো না—তা না। আর দশটা ফলমূলের মতই তার পাকস্থলী এই ইনসিগনিফিক্যান্ট দানাকে মাঝেমধ্যেই আপন করে নিত। কিন্তু এটা তখনো মানুষের প্রধান খাদ্য হয়ে ওঠেনি। ধান-গম তবে কী করে প্থিবীতে তাদের সাম্রাজ্য গড়ে তুললো?
মানুষ কি তবে কোন এক সকালে ঘুম থেকে উঠে প্ল্যান-প্রোগ্রাম করে ক্ষিকাজ শুরু করেছিলো?
উহুঁ। অধিকাংশ আবিষ্কারের মতই এটাও বেশ আকস্মিক। গম তো আর কাঁচা খাওয়া যায় না। এটা ঝেড়ে গুঁড়া করতে হত, তারপর রান্না করে খেতে হত। কাজেই যেখানে গমের দানা পাওয়া যেত, সেখানেই এটা খাওয়া হত না। একে অনেক আদর যত্ন করে বাসায় নিয়ে আসা হত। আসার পথে কিছু দানা অবশ্যই মাটিতে পড়ে যেত। সেই দানা থেকে নতুন গমের জন্ম হত।
এদিকে খাবারের অভাব হলে মানুষ এক জায়গা ছেড়ে আরেক জায়গায় মুভ করতো। যাবার পথে অতি অবশ্যই বন জঙ্গল পড়তো। রাস্তা ক্লিয়ার করার জন্য সেই বনজঙ্গল পুড়িয়ে তারা সামনে এগোত। ফলে বিচিত্র রকমের লতাগুল্ম মরে যেত ঠিকই। কিন্তু সেই জায়গা দখল করে নিত গমের মত কই মাছের প্রাণেরা।
আর আগে সূর্যালোক আর পানির মত রিসোর্সের জন্য ধান-গমকে আরো অনেকের সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে হত। লতাগুল্মের সংখ্যা আর ভ্যারিয়েশন কমে যাওয়ায় তারা বলা যায় একচেটিয়া ভোগ শুরু করে। পুঁজিবাদের নিয়মই হচ্ছে, যে পায়, সে আরো পায়। আর যে পায় না, সে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে। পুঁজিবাদী ধান-গম তাই মানচিত্রে একের পর এক তাদের বিজয় নিশান ওড়াতে থাকে।
যাই হোক, একটা সময় মানুষ খেয়াল করলো, বছরে একটা নির্দিষ্ট সময় গমের ফলন হচ্ছে। ঐ সময়টায় তারা ঐ ফলনের কাছাকাছি বউবাচ্চা নিয়ে থাকতে শুরু করলো। ধরা যাক, সেই সময়টা চার সপ্তাহ। পরের বার গমের ফলন আরো বেড়ে গেল। সমস্ত গম তুলে প্রসেস করতে তাই সময়ও একটু বেশি লাগলো। ধরা যাক, সেটা পাঁচ সপ্তাহ। এর পরের বার ছয় সপ্তাহ। এই করে করে এই ডিউরেশনটা বাড়তেই থাকলো। কালে কালে সেটা হয়ে উঠলো একটা স্থায়ী নিবাস।
আমরা আজকাল যাকে গ্রাম বলি, সেই গ্রামগুলোর জন্ম ঠিক এইভাবেই।
ইতিহাসের পাতায় পাতায় ‘লাক্সারি ট্র্যাপ’ এর ছড়াছড়ি।
১০ হাজার বছর আগে মানুষ যখন শিকার ছেড়ে পুরোপুরি চাষবাসে মন দেয়, তখন সে ভেবেছিলো, চাষবাস করলে তার জীবন বুঝি অনেক সুখের হবে। খাবারের সন্ধানে আর পথে পথে ঘুরতে হবে না। ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়াই খাদ্যের সন্ধান মিলিবে। বউ-বাচ্চা লইয়া বাড়িতে বসেই রক করা যাইবে।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক।
বাড়তি ফসল মানেই বাড়তি সুখ না। এই বাড়তি ফসল ফলাতে গিয়ে মানুষকে দিনরাত খেটে মরতে হল। মানুষের শরীর এই কষ্টের জন্য প্রস্তুত ছিল না। মানুষের শরীর হচ্ছে চিল করার জন্য। সে খাবে-দাবে, ঘুরবে-ফিরবে। পথের মধ্যে যা কুড়িয়ে পাবে, তাই দিয়ে পেটের ক্ষুধা মেটাবে। কিন্তু ফসল ফলাতে গিয়ে তাকে নিজের সাথে অনেক কম্প্রোমাইজ করতে হল।
ভালো ফসল ফলাতে হলে একদম মস্ণ, চকচকা শস্যক্ষেত্র চাই যেখানে নুড়ি, পাথর কিচ্ছু থাকতে পারবে না। মানুষ সকাল সন্ধ্যা খেটে সেগুলো পরিষ্কার করলো। এদিকে ধানগম হচ্ছে ব্রাহ্মণ গোত্রীয় ফসল। এরা এদের ত্রিসীমানায় কোন ছোটলোক আগাছা সহ্য কতে পারে না। এই আগাছা নিড়াতে মানুষকে একটা সিগনিফিক্যান্ট সময় দিতে হল। এদের ক্ষুধা-ত্ষ্ণাও অনেক বেশি। খালি ব্ষ্টির পানি দিয়ে এদের পিপাসা মিটতো না। এদের পিপাসা মেটানোর জন্য মানুষকে দূর-দূরান্ত থেকে কাঁধে করে পানি বয়ে নিরে আসতে হল। গবাদি পশুর বিষ্ঠা দিয়ে মেটাতে হলো এদের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা।
আমরা মনে করি, আমরা জঙ্গুলে ধান-গমকে নিজেদের বুদ্ধিবলে পোষ মানিয়েছি। সত্যিটা হচ্ছে এই যে, আমরা ধান-গমকে পোষ মানাইনি, উলটো ধান-গম আমাদের পোষ মানিয়েছে। ওদের সুখ-সুবিধার জন্য আমরা নিজেদের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছি। শিকারী জীবন ছেড়ে ওদের বসতির পাশে নিজেদের বসতি গড়েছি। বার রকমের ফলমূল খাওয়া ছেড়ে ওরা যেন ভালো থাকে, ওদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন ভালো থাকে—তার দিকে নজর দিয়েছি। এই করে করে সামান্য একটা ঘাস, যেটা হয়তো কারো চোখেই পড়তো না—আজ প্থিবীর পঁচিশ লাখ বর্গকিলোমিটারেরও বেশি জায়গা জুড়ে নিজেদের সাম্রাজ্য স্থাপন করে বসে আছে।
এই যে এতো ভালবাসা, এতো ত্যাগ-তিতিক্ষা—এর বিনিময়ে কী পেলাম? ফুড সিকিউরিটি? উহুঁ। আগে যেখানে আমরা প্রক্তির কাছ থেকে দু’হাত ভরে নিতাম,, সেখানে আমরা দু-তিনটা ফসলের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লাম। বৈচিত্সরের অভাবে আমাদের শরীরের ইম্যিউন সিস্টেম দুর্বল হয়ে পড়লো। তার উপর সময়মত ব্ষ্টি না হলে আমরা শেষ। বউ-বাচ্চা নিয়ে না খেয়ে মরতে হল।
শুরু শুরুতে অবশ্য বাড়তি ফসল দেখে আমাদের চোখ টাটিয়ে গেলো। আমরা স্থায়ী বসতি গড়ে বছর বছর বাচ্চা নেয়া শুরু করলাম। ভাবলাম, খাবার টেনশন তো নাই। বাচ্চা নেয়াই যায়। ভেবেও দেখলাম না, এতো গুলো মুখের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে বাড়তি ফসল আছে কিনা। সেই সামান্য উদ্ব্ত্ত নিয়ে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে গেলো। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চাটা ঠিকমত না খেতে পেয়ে মারা পড়লো। ক্ষি সমাজের নিয়মই হয়ে গিয়েছিল এমন, যে প্রতি তিনটা বাচ্চার মধ্যে একটা অপুষ্টি নয়তো অসুখ-বিসুখে মারা যাবেই। আর বসতিগুলোও ছিল ঘিঞ্জি আর রোগজীবানূর আড়ৎ। যে কয়টা মরতো, জন্ম নিত তার চেয়ে বহুগুণ বেশি। সেই বাড়তি মুখের অন্ন যোগানোর জন্য মানুষকে আরো বেশি বেশি ফসল ফলাতে হল। আরো বেশি ফসল্ আরো বেশি খাটনি।