অস্ট্রেলিয়ার প্রাণীকুল এই বোঝাপড়ার সময়টুকুও পায়নি। দোপেয়ে দৈত্য দেখলে যে এদের এড়িয়ে চলতে হবে—এই নলেজটুকু এরা জিনের মধ্য দিয়ে পরের প্রজন্মের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। মানুষ দেখে এরা আগের মতই খুব কুলভাবে ঘুরে বেড়িয়েছে। ফলাফল, তেলাপোকা টিকিয়া রহিয়াছে, কিন্তু এরা খুব কুলভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
কথা হচ্ছে, যথাযথ তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই আমরা এই গণহত্যার দায় মানুষের ঘাড়ে চাপাতে পারি কিনা। জবাব হচ্ছে, পারি। যারা মানুষকে এই দায় থেকে ইনডেমনিটি দিতে চান, তাদের যুক্তি হচ্ছে—ভয়ানক কোন প্রাক্তিক দুর্যোগ হয়তো এই প্রাণীকুলের বিলুপ্তির কারণ। বরফ যুগে যেমনটা ঘটে। প্থিবীর ইতিহাস বলে, এক লাখ বছর পর পর একে বরফ যুগের মুখোমুখি হতে হয়েছে। আর এই প্রতিকূল আবহাওয়ায় প্রাণীকুলের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ প্রতিবার বিলুপ্ত হয়ে যায়।
গন্ডগোলটা এইখানেই। শেষ বরফ যুগ আমরা দেখেছি পঁচাত্তর হাজার বছর আগ থেকে পনের হাজার বছর আগ পর্যন্ত। এর প্রকোপ সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল এক সত্তর হাজার বছর আগে আর এক বিশ হাজার বছর আগে। মানে ঐ বরফ যুগের একবারে শুরুতে আর শেষ দিকে। যাবার আগে একেবারে কাঁপিয়ে দিয়ে গিয়েছিল আমাদের। ডাইপ্রোটোডন বেচারা এই বরফযুগ আর তার আগের দশটার মত বরফযুগ লাইক এ্যা বস পার করে এসেছে। ৪৫ হাজার বছর আগে তাহলে কী এমন হল যে সে নিজের অস্তিত্ব আর টিকিয়ে রাখতে পারলো না? মানুষের আগমন ছাড়া তো আশেপাশে বলার মত আর কোন ঘটনা চোখে পড়ে না। বেচারা ডাইপ্রোটোডনই যে কেবল মারা খেয়েছে, তা নয়। আরো অনেকেই এই ম্যাসাকারের শিকার। পুরো ব্যাপারটাকে তো আর কাকতাল বলা যায় না।
ও, আরেকটা ব্যাপার। প্রাক্তিক দুর্যোগ যখন কোথাও আঘাত হানে, স্থলবাসী প্রাণীদের সাথে সামুদ্রিক প্রাণীদের উপরও সে সমান তেজে আঘান হানে। বাদ যাবে না কোন শিশু টাইপ অবস্থা। অস্ট্রেলিয়ায় ঘটে যাওয়া এই গণহত্যায় কিন্তু কোন সামুদ্রিক প্রাণীড় গায়ে আঁচড়টাও পড়েনি। সম্ভবত মানুষের হাতে তখনো সেই টেকনোলজি আসে নি যে, সামুদ্রিক প্রাণীর গায়েও হাত তুলবে। থাকলে হয়তো এদেরও খবর ছিল।
এই যে আমরা যত দোষ মনুষ্য ঘোষের উপর চাপাচ্ছি, তার পেছনে আসলে মানুষের আরো কিছু ক্তকর্ম দায়ী। সবগুলো ডাটা ইন্টারপোলেট করলে আপনিও হয়তো মানুষকেই দায়ী করবেন। কোন দৈব দুর্যোগ বা ভিনগ্রহী দেবতাকে নয়।
মানুষের স্বভাবই এই যে, সে মোটামুটি যেখানেই গেছে, তার হাত রক্তে রাঙিয়ে এসেছে। নিউজিল্যান্ডের কথাই বলি না কেন। এটা কিন্তু খুব পুরনো দেশ নয়। মানুষ প্রথম এইখানে বসতি গড়ে মাত্র ৮০০ বছর আগে। ইউরোপীয়রা আসে আরো ৩-৪ শ’ বছর পর। মাওরিস নামক এক জনগোষ্ঠী এইখানে বসতি গড়ার কয়েকশ’ বছরের মধ্যেই এখানকার অতিকায় প্রায় সব প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যায়। ইউরোপীয়দেরও হয়তো এক্ষেত্রে অসামান্য অবদান আছে, কিন্তু মাওরিসদের অবদানও আমরা অস্বীকার করতে পারি না। অবলা পাখিরাও এই হত্যাযজ্ঞ থেকে রেহাই পায়নি। তাদের সমাজের ৬০ শতাংশও এই সময়টায় বিলুপ্ত হয়ে যায়।
একই ঘটনা ঘটে আর্কটিক মহাসাগরের ম্যামথদের সাথে। উত্তর মেরুর এই বাসিন্দারা মানুষের ভয়ে এশিয়া, ইউরোপ হয়ে পিছাতে পিছাতে উত্তর মেরুতে আশ্রয় নেয়। মানুষের যখন বুদ্ধিব্ত্তিক বিকাশ হচ্ছিল, তখনো এরা র্যাঙ্গেল দ্বীপে এদের ছোট্ট নীড়ে সুখে শান্তিতেই ঘর সংসার করছিল। এদের এই সুখ বেশিদিন টিকলো না। চার হাজার বছর আগে মানুষ প্রথম র্যাঙ্গেল দ্বীপে পা রাখে। আর ঐ সময়েই এদের শেষ সদস্যটি বেঁচে ছিল বলে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়।
কাকতাল? সিনেমার স্ক্রিপ্ট ছাড়া এতোগুলো কাকতাল নিশ্চয়ই সম্ভব নয়।
মানুষ যে প্থিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সিরিয়াল কিলার, এখন বিশ্বাস হল তো?
মানুষের গল্প বলতে গেলে মধ্যপ্রাচ্যের কথা বারবার আসবেই। অনুকূল আবহাওয়ার কারণেই হোক আর ইন্টেলেকচুয়াল সুপেরিওরিটির কারণেই হোক, এখানকার মানুষই বারবার সভ্যতার পত্তন করেছে। আপনি চান বা না চান, আমাদের শেকড়ের সন্ধান করতে হলে এদের কাছে বারবার ফিরে আসতেই হবে।
সত্তর হাজার বছর আগে মানুষ প্রথম মধ্যপ্রাচ্যে আসে। পরবর্তীতে বেশ একটা লম্বা সময় জুড়ে সে চাষবাস ছাড়াই থাকে। প্রক্তিতেই এতো সম্পদ ছড়ানো ছিল যে মানুষের খেয়েপরে বেঁচে থাকা নিয়ে কোন টেনশন ছিল না। মানুষের প্রথম ও সবচেয়ে প্রবল ইনস্টিংক্ট হচ্ছে শিকার। এই করেই তার দিব্যি চলে যেত।
তাই বলে যে প্রক্তিতে সম্পদ যে সবসময় একই পরিমাণে ছিল তা নয়। মানুষ মানুক না মানুক, প্রক্তি কিন্তু সাইনুসয়ডাল কার্ভ ঠিকই মেনে চলে। কখনো সে সম্পদে উপচে পড়ে, এর পরেই হতো একটা বিশাল সময় যায় অভাব ও দারিদ্র্যে।
প্রক্তির এই মেকানিজমের সাথে মানুষের একটা অঘোষিত বোঝাপড়া ছিল। প্রাচুর্যের সময় লোকে বেশি বাচ্চাকাচ্চা নিত। আর অভাবের সময় কম।
প্রক্তি নারীদের জন্যও ফিডব্যাকের ব্যবস্থা রেখেছে। প্রাচুর্যের সময় নারীরা তাড়াতাড়ি বয়োসন্ধিতে পৌঁছাতো। ফলে গর্ভবতীও হতো তাড়াতাড়ি। আর অভাবের সময় উলটো।
১৮ হাজার বছর আগে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। বরফ যুগ সরে গিয়ে জায়গা করে দেয় গ্লোবাল ওয়ার্মিং কে। ফলে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে, সেই সাথে ব্ষ্টিপাতও। যাকে বলে ক্ষিকাজের জন্য আদর্শ পরিবেশ। গম জাতীয় খাদ্যশস্যের জন্য পারফেক্ট আবহাওয়া। ‘সারভাইভাল অফ দ্যা ফিটেস্ট’ বলে একটা কথা আছে। এটা সবার জন্যই সমান সত্য। এই গরম আবহাওয়ায় গম জাতীয় শস্য প্থিবীতে নিজের দখল বুঝে নিতে থাকে আস্তে আস্তে।