ব্যাভারিয়া (আজকের জার্মানিতে) জাস্ট একটা কবরের মধ্যেই খালি নারী ও শিশুদের লাশ পাওয়া গেছে। কোনরকম যত্ন ছাড়াই স্তূপ করে রাখা লাশ। প্রতিটা লাশই সেকালের অস্ত্র দিয়ে ভয়ানক রকম খুঁচিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা। অল্প যে ক’টা পুরুষ কঙ্কাল পাওয়া গেছে, প্রতিটাতেই অত্যাচারের চিহ্ন আরো ভয়াবহ। বোঝাই যায়, কোন এক গোত্রের উপর সেসময় গণহত্যা হয়েছে। হত্যা শেষে সবগুলো লাশ নির্মমভাবে এক কবরে চাপা দেয়া হয়েছে। এর সাথে কেবল তুলনা চলে নাৎসী জার্মানদের কিংবা ৭১ সালে পাকিস্তানিদের বর্বরতার।
আমাদের হাতে এভিডেন্স আসলে খুব কম। কাজেই আমরা নিশ্চিৎ করে বলতে পারছি না অধিকাংশ মানুষ পর্তুগাল আর ইসরায়েলের সেকালের অধিবাসীদের মত শান্তশিষ্ট ছিল না দানিউব উপত্যকার মত খুনে, রক্তলোলুপ ছিল।
তবে সেকালের দানিয়ুব বা সুদানের তুলনায় কিংবা এই তো সেদিনের বিশ শতকের তুলনায় আমরা যে এখনো অনেক ভালো আছি—একথা নিঃসন্দেহেই বলা যায়। শতাব্দীর শেষাবধি এই কনসিস্টেন্সি ধরে রাখতে পারি কিনা—সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।
০৩. ভুলগুলো
ভুলগুলো যে আমরা ইচ্ছে করে করি—তা না। বহু বছরের অভ্যাসের ফসল এই ভুলগুলো।
যেমন কলম্বাসকে আমরা আমেরিকার আবিষ্কর্তা ধরি। কিংবা জেমস কুককে অস্ট্রেলিয়ার। অথচ এই মানুষেরা আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কারের বহু আগে থেকেই সেখানে মানুষ বসবাস করতো।
৪৫ হাজার বছর আগেই যেমন মানুষ অস্ট্রেলিয়ার বুকে প্রথম পা রাখে। যে মানুষটি প্রথম আফ্রো-এশিয়ার গণ্ডী ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ার বুকে তার পদচিহ্ন এঁকে দিয়েছিল, তার নাম-ঠিকানা আমরা জানি না। অস্ট্রেলিয়ার সত্যিকার আবিষ্কারক যদি কেউ হয়, তবে সেই নাম না জানা মানুষ কিংবা মানুষী, জেমস কুক নন।
বহু বছরের চর্চায় আমাদের মধ্যে একটা ধারণা বদ্ধমূল ঢুকে গেছে যে, আবিষ্কর্তা মানে শাদা মানুষ হতে হবে। শাদা মানুষের ইতিহাস যে বড়জোর লাস্ট এক হাজার বছরের, একথা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই। আজকের এই সভ্যতা হয়তো শাদা মানুষের দান, কিন্তু ভূখণ্ডগুলোর আবিষ্কারের ক্তিত্ব অন্তত নয়। কলম্বাস বা কুককে বড়জোর ভূখণ্ডগুলোর পুনরাবিষ্কারক বলা চলে।
যাই হোক, চাঁদে যাওয়া যেমন মানুষের ইতিহাসে একটা বড় মাইলস্টোন ছিল, অস্ট্রেলিয়া যাত্রাও তেমন। বলতে কি, অস্ট্রেলিয়াই মানুষের তৈরি প্রথম উপনিবেশ।
The Martian মুভিতে একটা দারুণ কথা আছেঃ যখন তুমি কোথাও ফসল ফলানো শুরু করবে, তখন তুমি সেই জায়গাটাকে কলোনাইজ করে ফেললে। অস্ট্রেলিয়া সেই অর্থে মানুষের প্রথম কলোনী। এই ব্যাপারটা মাথায় রেখেই হয়তো কুক সাহেব অস্ট্রেলিয়া আসার সময় সাথে করে আপেল, আঙুর আর পীচফল নিয়ে এসেছিলেন। সাহেব জানতেন না যে তারও বহু হাজার বছর আগেই মানুষ এখানে এসে ছোটখাটো কলোনী তৈরি করে বসেছে।
ভেবে অবাক হতে পারেন, ৪৫ হাজার বছর আগে মানুষের হাতে কি এই টেকনোলজি ছিল কিনা যার দৌলতে সে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অস্ট্রেলিয়া এসে পৌঁছাবে? মানচিত্রের দিকে ভালো করে লক্ষ করলে ব্যাপারটা আরেকটু পরিষ্কার হবে। লোকে বলে, সম্ভবত এই মানুষেরা ইন্দোনেশিয়ার কোন উপদ্বীপ থেকে এসেছিলো। জাহাজ না হোক, নৌকা বা ভেলা নিশ্চয়ই তাদের ছিল। এই সিম্পল প্রযুক্তি যে আমাদের কতোটা এগিয়ে দিয়েছে, চোখে আঙুল দিয়ে না দেখালে তা অনেক সময় বোঝা যায় না।
আর সব সামুদ্রিক প্রাণীর কথা ভাবুন। সমুদ্রে নিজেদের দাদাগিরি প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের হাজার বছরের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। পাখনা আর ফুলকার মত অংগ-প্রত্যঙ্গ ডেভেলপ করতে হয়েছে। মানুষকে এইসব শারীরিক প্যারা নিতে হয়নি। সামান্য বুদ্ধি খাটিয়ে নৌকা বানিয়েই সে কাজ হাসিল করে নিয়েছে। মানুষের এই বুদ্ধিব্ত্তিক বিপ্লব অবশ্য আর সবার জন্য খুব সুখবর বয়ে আনেনি।
মানুষের আগমনের আগ পর্যন্ত মহাদেশগুলোর জীববৈচিত্র্য আপন গতিতে বিবর্তিত হচ্ছিল। মানুষ এসে সেই বিবর্তনের ধারায় একটা প্রলয় ঘটিয়ে দেয়। এতোদিন পর্যন্ত মানুষ প্রক্তির সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিচ্ছিল। যেদিন থেকে মানুষ সমুদ্র পাড়ি দিল, সে বুঝলো—সে আসলে অসীম ক্ষমতার অধিকারী। তার আর প্রক্তির সাথে খাপ খাইয়ে নেবার প্রয়োজন নেই। দরকারে সেই প্রক্তিকে তার মত করে বদলে নিতে পারবে। আর হতেও লাগলো তাই।
এতোদিন মানুষ বাঘ-সিংহের মোকাবেলা করেই অভ্যস্ত ছিল। অস্ট্রেলিয়ায় এসে তারা মুখোমুখি হল ক্যাঙ্গারু, কোয়ালা আর মারসুপিয়ান সিংহের মত নতুন প্রজাতির। আর মজার ব্যাপার হল, এদের প্রায় সবাই-ই কয়েক হাজার বছরের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো। মানুষ যখন অস্ট্রেলিয়ায় পা রাখে, তখন গোটা মহাদেশে অন্তত চব্বিশটা প্রজাতি ছিল যাদের ওজন পঞ্চাশ কেজির বেশি। সংগানুযায়ী, এদের অতিকায় প্রানীর দলে ফেলা যায়। এদের মধ্যে তেইশ জনই প্থিবীর মায়া ত্যাগ করে বৌ-বাচ্চা সহ বিলুপ্ত হয়ে গেলো।
আচ্ছা, আফ্রিকায় তো বাঘ-সিংহ মানুষের সাথে যুদ্ধ করে টিকে রইলো। কোয়ালা আর মারসুপিয়ায়নরা তবে মারা পড়লো কেনো?
খুব সিম্পল। মানুষ যখন থেকে হাতিয়ার বানানো শুরু করেছে, বাঘ-সিংহ ও সেই সাথে মানুষকে এড়িয়ে চলা শিখে গেছে। অন্তত দলবদ্ধ মানুষকে তো বটেই। এরা সাতচল্লিশের দাঙ্গা দেখেনি। না দেখেই তারা বুঝে গেছিলো যে, দলবদ্ধ মানুষের চেয়ে হিংস্র আর কিছুই হতে পারে না। এদের গায়ের চামড়া তাই কিছুটা হলেও রক্ষা পেয়েছে।