এইখান থেকেই সম্ভবত ধারণা আসে যে, হরিণের কাছে মেসেজ পৌঁছানো গেলে ম্ত আত্নার কাছে পৌঁছানো যাবে না কেন? এইখান থেকেই প্রাচীন সমাজে শামানের উৎপত্তি। শামানদের কাজ ছিল এই জগতের মানুষের সাথে অন্য জগতের মানুষের যোগাযোগ ঘটিয়ে দেয়া। এই অন্য জগৎ মানে নট নেসেসারিলি পরজগৎ। অনন্ত অসীম পরজগত কিংবা একক ঈশ্বরের ধারণা তখনো গড়ে ওঠেনি। কিন্তু মানুষ মরে গেলেও যে তার আত্না মরে না আর সেই আত্না জীবিতাবস্থায় তার কাছের মানুষদের আশেপাশেই ঘুরে বেড়ায়, তাদের ভাল করে কিংবা অনিষ্ট করে—এই ব্যাপারে তাদের একটা পাকাপাকি রকম বিশ্বাস গড়ে উঠেছিল।
অবশ্য আবারও ঐ একই কথা। পুরোপুরি নিশ্চিৎ করে আমরা কিছুই বলতে পারি না। অতীতকে ডিকোড করার জন্য আমাদের হাতে যে সামান্য কিছু চিত্রকর্ম আর ফসিল ছাড়া তেমন কিছু নেই।
বলা হয়, আমরা সবাই কাবিলের সন্তান। বড় ভাই কাবিল ছোট ভাই হাবিলকে খুন করে প্থিবীতে তার লিগ্যাসী প্রতিষ্ঠা করে গেছে। কাজেই, অল্পবিস্তর খুনে সত্তা আমাদের সবার মধ্যেই কমবেশি আছে। কারোটা প্রকাশ্য, কারোটা শিক্ষা-সংস্ক্তির মোড়কে এখনো ঢাকা পড়ে আছে।
এই হাবিল-কাবিলের যে গল্পটা আমরা ছোটবেলায় শুনেছি, তাতে কিছুটা ফাঁকি আছে। হাবিল ভালো আর কাবিল খারাপ—এই বাইনারীর ছাঁচে পুরো ঘটনা ফেলতে গিয়ে মূল বিষয়টাই আমাদের স্পর্শ করা হয় না। কেননা প্থিবীর বাকি অর্ধেক গল্পের মতই এই গল্পের মূলেও আছে সেক্স।
হাবিল-কাবিল দুই ভাই। এতোদূর পর্যন্ত গল্পটা ঠিকঠাক এগোয়। সমস্যাটা হয় তখনই, যখন হাবিলের সাথে তার এক যমজ বোনের জন্ম হয়। আর কাবিলের সাথে জন্ম নেয় আরেক যমজ বোন।
এখন হাবিল-কাবিল হচ্ছে আদমের দুই সন্তান। প্থিবীতে তখন মানুষ বা জনপ্রানী বলতে আর কেউ নেই। কাজেই, মানবজাতির বংশরক্ষার জন্য আপন বোনকে বিয়ে করা ছাড়া আর কোন গতি ছিল না।
আল্লাহ তখন একটা নিয়ম করে দিলেন। হাবিল বিয়ে করবে কাবিলের সাথে জন্ম নেয়া যমজ বোনকে। কাবিলের ক্ষেত্রে সেটা ভাইস ভার্সা।
এখন দেখা দিল আসল সমস্যা। কাবিলের সাথে জন্ম নেয়া যমজ বোনটা বেশি সুন্দরী। কাবিল তাকেই বিয়ে করতে চায়। এদিকে হাবিল আল্লাহর আদেশের ভয়েই হোক কিংবা কাবিলের যমজের সৌন্দর্যে আক্ষ্ট হয়েই হোক—সেও তাকেই বিয়ে করতে চায়। হাবিলের সাথে জন্ম নেয়া যমজটার ওদিকে কোন খবর নেই। সে সুন্দরী নয় বলে কেউ তাকে পাত্তা দেয় না।
কাজেই, সুন্দরী মেয়েরা সামান্য ভাব নিলেও এতে রাগ করার কিছু নেই। স্ষ্টির শুরু থেকেই এমনটা চলে আসছে।
যাই হোক, আদম তখন তাদের একটা প্রস্তাব দিলেন। দু’জনকে বললেন আল্লাহর উদ্দেশ্যে কিছু একটা কুরবানী দিতে। যার কুরবানীতে আল্লাহ লাইক দিবেন, সেই কাবিলের যমজ বোনকে পাবে।
কাবিল কিছু শস্য অফার করলো আল্লাহকে। আর হাবিল দিল একটা সুস্থ সবল ছাগল। বলা বাহুল্য, হাবিলের কুরবানী কবুল হল।
কাবিল মনে করলো, এই সব তার বাপের কারসাজী। হাবিল তার বাপ আদমের পছন্দের ছেলে বলে আদম তার জন্য আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করেছে।
বাকি ইতিহাস আমাদের জানা। কাবিল হাবিলকে মেরে ফেললো। এইখানেই গল্প শেষ নয়। মেরে ফেলার পর সে বিরাট অনুতপ্ত হল। আর হাবিলের লাশ নিয়ে পথে পথে ঘুরতে থাকলো।
হাবিল-কাবিলের এই মিথ যে কেবল আব্রাহামিক কালচারেই সীমাবদ্ধ—তা নয়। রোম নগরীর প্রতিষ্ঠার পেছনেও এমন একটা মিথ চালু আছে। দুই ভাইয়ের যুদ্ধ ও রক্ত থেকে রোম নগরীর পত্তন। একই মিথ সম্ভবত এক এক জায়গায় এক একভাবে ছড়িয়েছে। আসল কথা, মানবজাতির ভায়োলেন্সের ইতিহাস খুব নতুন কিছু নয়।
বাস্তবে ভায়োলেন্স ছিল বলেই মিথে সেটা বারবার এসেছে। কাজেই, মিথ ছেড়ে এবার বাস্তবে আসি। পর্তুগালে একটা প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ করে দেখা গেলো, ৪০০ কঙ্কালের মধ্যে মাত্র দুটোতে ভায়োলেন্সের চিহ্ন পাওয়া গেছে। একই রকম ফলাফল পাওয়া গেছে ইসরায়েলেও। এখানে ৪০০ কঙ্কালের মধ্যে মাত্র একটিতে ভায়োলেন্সের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এই ফলাফলগুলো মানুষের হিংস্রতার সপক্ষে খুব জোরালো প্রমাণ নয়। ইন্টারেস্টিং রেজাল্ট পাওয়া গেছে দানিউব উপত্যকায়। এখানে ৪০০ কংকালের ১৮টিতে ভায়োলেন্সের প্রমাণ স্পষ্ট। শুনে সংখ্যাটা কম মনে হতে পারে। কিন্তু পার্সেন্টেজ করলে ব্যাপারটার ভয়াবহতা বোঝা যাবে। জরিপের ফলাফলকে সঠিক ধরলে বলতে হয়, শতকরা ৪.৫ ভাগ মানুষ সে উপত্যকায় মারামারি খুনোখুনি করে মরতো। আজ এই পার্সেন্টেজ নেমে এসেছে ১.৫ এ। সমস্ত যুদ্ধ, টেরোরিস্ট এ্যাটাক আর লোকাল সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাস মিলিয়েই। তাইলেই বোঝেন, দানিয়ুব উপত্যকার মানুষ সেকালে কীরকম হিংস্র ছিল। এর সাথে কেবল তুলনা দেয়া যায় বিশ শতকের হিংস্রতার। লিখিত ইতিহাসে মানবজাতি সবচেয়ে বাজে সময় পার করেছে বিশ শতকে। দু দুটো বিশ্বযুদ্ধের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাদের। ফলাফল—বিশ শতকে প্রতি ১০০ জনে ৫ জন ভায়োলেন্সে মরেছে।
হাবিল-কাবিলের গল্প বড়জোর ৬ হাজার বছর পুরানো। সুদানেই ১২ হাজার বছর আগের এক কবরস্থানে ৫৯টা এমন কঙ্কাল পাওয়া গেছে যার মধ্যে ২৪টার গায়েই তীরের ফলার চিহ্ন পাওয়া গেছে। এক মহিলার গায়ে তো রীতিমত ১২টা ক্ষতচিহ্ন। যুদ্ধ শেষে পরাজিত গোত্রের নারীদের সাথে কী ব্যবহার করা হয়—আমরা সবাই জানি। এই কালচার হঠাৎ মধ্যযুগে তৈরি হয়নি। বহু আগে থেকেই এই নেশা আমাদের রক্তে মিশে আছে।