এবার মাদাম ফ্রাঞ্চি বললেন, ‘লুসিয়েন, তোমার নিজের জন্য তিন কোয়ার্টার ঠিক হলেও। এই পাহাড়ি রাস্তায় ইনি কি ঠিক তোমার সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে পারবেন?’
লুসিয়েন মাথা নেড়ে বলল, ‘সেটা ঠিক তাহলে অন্তত দেড় ঘণ্টা ধরে রাখতে হয়।’
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মাদাম বললেন, ‘তাহলে এবার রওনা দিতে হয়।’
মাদাম হাত বাড়িয়ে দিলে, লুসিয়েন আগের মতোই সম্মানের সাথে হাতে চুমু খেল, তাহলে আমরা যাই মা?
লুসিয়েন আমার দিকে ফিরে বলল, ‘এখনও ভেবে দেখুন! আমার সঙ্গে পাহাড়ে ঘুড়ে না বেরিয়ে, এখানে বসে আস্তে খাবারটা শেষ করেন। তারপর নিজের ঘরে গিয়ে আগুনে আরামে হাত পা গরম করে—’
আমি এখানেই বাঁধা দিয়ে উঠলাম, ‘আমাকে খুনি দেখাবেন বলেছেন। আমি খুনি দেখবই।’
.
তাড়াতাড়িই রেডি হয়ে গেলাম।
প্যারিস থেকে বের হবার সময় একটা বিশেষ ধরনের বেল্ট আমি বানিয়েছিলাম। সেটাই এবার কোমরে বেঁধে নিলাম। তার এক পাশে ঝোলানো একটা শিকারের ছোরা, আর এক পাশে গুলি। লুসিয়েনের কোমরে বুলেট ভরা ব্যাগ এবং কাঁধে দোলনা ম্যান্টন বন্দুক। তার মাথায় চুড়া জােড়া টুপি, তাতে সুন্দর ফুলের কাজ করা।
গ্রিদো জিজ্ঞাসা করল, ‘মালিক, আমি কি আসব?
না, দরকার নেই-বলল, লুসিয়েন তবে ডায়ামন্টকে ছেড়ে দাও। পাখিটাখি ধরতে পারে, চাঁদের যা আলো, তাতে দিনের মতোই গুলি চালানো যাবে।
এক মিনিট পরেই একটা কুকুর লাফাতে লাফাতে আমাদের কাছে চলে এলো। বাড়ি থেকে কিছুদূর গিয়েই লুসিয়েন ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, গ্রামের ভেতর জানিয়ে দাও পাহাড়ের উপর যদি বন্দুকের আওয়াজ শুনতে পায়, বুঝবে আমি গুলি চালিয়েছি। সে অন্য কেউ না।
‘আমি এক্ষুণি যাচ্ছি’ বলল গ্রিদো।
সামনে চলতে চলতে আমাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল লুসিয়েন, ‘এ কথাটা না বললে সমস্যা ছিল, আমরা পাহাড়ে পাখি মারছি। ওদিকে সুল্লাকারোর রাস্তায় দাঁড়িয়ে গ্রামবাসীরা তার শব্দ শুনে ভাববে আবার কলোনা আর আলৰ্ত্তিদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। সমস্ত গ্রাম আবার জড়িয়ে পরবে তাতে।’
আমরা একটু সামনে এগিয়ে ডাইনে একটা সরু রাস্তা ধরলাম। সেটাই সোজা পাহাড়ে গিয়ে উঠেছে।
৪. চাঁদ উঠেছে কাগনা পাহাড়ের পিছনে
৪.
মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ। মোটেই গরম নেই, ঠাণ্ডা বাতাস সমুদ্রের দিক দিয়ে এসে আবহাওয়াটাকে সুন্দর করে তুলেছে।
নীল আকাশে চাঁদ উঠেছে কাগনা পাহাড়ের পিছনে। এই পাহাড় কর্সিকা দ্বীপকে দুই ভাগ করেছে। একই দ্বীপে তৈরি হয়েছে রাজ্য, তুচ্ছ কারণেও তারা পরস্পরকে আক্রমণ করে বসে। ঘৃণা করে একে অপরকে।
চড়াই উঠতে উঠতে চারদিক চেয়ে দেখছি। টাভরো নদী কোথায় দিয়ে বইছে তা দেখার চেষ্টা করছি। কিন্তু তার কোনো চিহ্ন চোখে পড়ছে না। যদিও দূরে শান্ত ইস্পাতের আয়নার মতো দেখা যাচ্ছে ভূমধ্যসাগরের জলরাশিকে।
রাতের নিজস্ব কিছু শব্দ আছে। দিনে হয়তো এগুলো হাজার শব্দের ভিড়ে চাপা পড়ে থাকে, বা শুরুই হয় রাতের সাথে সাথে। লুসিয়েন এতে পুরো অভ্যস্ত। তাই তার উপর এর কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু আমি। নতুন বলেই সব শব্দকেই অদ্ভুত লাগছে, করে তুলছে আগ্রহী।
একটি তিন রাস্তার মোড়ে এসে লুসিয়েন থামল। একটা রাস্তা পাহাড় ঘুরে এগিয়ে গেছে। অন্যটা সোজা উঠে গিয়েছে উপরে। দ্বিতীয় রাস্তাটির চিহ্ন এত কম যে চোখে না পড়ার মতোই। লুসিয়েন জিজ্ঞাসা করল, ‘ঠিকমতো উঠতে পারবেন তো।’
আমি উত্তর দিলাম, ‘উঠতে ঠিকই পারব। তবে মাথা ঘুরতে পারে।’
‘মাথা ঘুরবে কেন?’
‘গভীর খাদ দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে।’
‘তাহলে এ পথেই যাওয়া যাক, এ পথ দুর্গম হলেও কোনো খাদ নেই। আর এ পথে সময় অন্তত তিন কোয়ার্টার বাঁচবে।’
‘তাহলে এ পথেই চলুন।’
‘হোনি গাছের একটা ঝোলের ভেতর লুসিয়েন ঢুকল, আমিও তার পিছনেই চললাম। ডায়ামান্টি ঝোঁপঝাড় দেখতে দেখতে পঞ্চাশ ষাট গজ আগে চলছে।’
কিছুক্ষণ পরপর থেমে দাঁড়িয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
প্যারিসে দেখেছি উঁচু পদের কর্মচারীরা ঘোড়াকে দুই ভাবে ব্যবহার করে। সকালে গাড়িতে লাগিয়ে অফিসে যায়। আবার বিকেলে সেই ঘোড়ার পিঠে চেপে হাওয়া খেতে বের হয়। এই ডায়ামাল্টির কাজও সেই ধরনের। এ দু পা ওলা মানুষ দস্যু এবং চার পা ওলা জন্তু শিকারে সমানভাবেই অভ্যস্ত। এ ব্যাপারে লুসিয়েনকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার ধারণা ঠিক কি না?
‘না, আপনার ভুল হয়েছে, ডায়ামাল্টি মানুষ এবং জন্তু দুই-ই শিকারে অভ্যস্ত বটে, তবে যে মানুষের উপর তার আক্রোশ তারা মোটেই দস্যু শ্রেণির না, তারা হলো সৈনিক, ঘোড়সওয়ার পুলিশ আর স্বেচ্ছা সৈনিক, এই তিন সম্প্রদায়ের উপর তার রোখ।
‘তাহলে ডায়ামাল্টি কি ডাকাতের কুকুর?
‘হ্যাঁ, শুরু থেকেই মালিক ছিল এক অলার্তি। বহুদিন সে জঙ্গলে পালিয়েছিল। পালিয়ে থাকার সময় তার প্রয়োজনে আমি তাকে খাবার আর গুলি বারুদ এগুলো মাঝে মাঝে দিতাম। কলোনাদের হাতে লোকটি মারা গেল। ডায়ামাল্টি পরদিন আমার কাছে চলে এলে। আগেও জিনিসপত্র নিতে আমাদের বাড়ি আসত। কাজেই অসুবিধা হয়নি।
আমি জানালাম, কিন্তু আমার ঘর থেকে এ ছাড়াও আর একটা কুকুর চোখে পড়ল।
‘ব্রুক্কো, তার মালিক ছিল আবার বলো না। যে মারা যায় এক অলাৰ্ত্তির হাতে। জানেন এখন আমি কি করি? যখন কোনো কলোনাদের সাথে দেখা করি, সাথে থাকে ব্রুক্কো, আর যখন কোনো অৰ্ত্তির কাছে যাই, তখন সাথে নিই ডায়ামাল্টিক। কেউ যদি কোনোদিন ভুল করে কুকুর দুটো শিকল এক সাথে খুলে দেয়। তাহলে দুটোই নিজেরা মারামারি করে মারা যাবে।