‘আপনি তো জানেন, আমরা যমজ ভাই।’
‘হ্যাঁ তা জানি, গাইড আমাকে জানিয়েছিল।
‘কিন্তু এটা শোনেননি জন্ম হবার সময় আমরা জোড়া লাগানো অবস্থায় ছিলাম?
‘না, এটা শুনিনি।’
‘ডাক্তার এসে অপারেশন করে আমাদের দুই ভাইকে আলাদা করে।’ এর ফলে আমরা দুই ভাই যত দূরেই থাকি। একজনের সাথে অন্যজনের একটা মানসিক যোগ রয়েছে। একজন শারীরিক মানসিক যে কোনো ভাবান্তর হলে, অপরজন তা সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করবে। বেশ কয়েকদিন থেকেই আমার মনটা ভালো লাগছে না-তার একটাই মানে হতে পারে যে, ভাই-এর নিশ্চয়ই কোনো অসুখ হয়েছে। মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে যে, লুই কোনো বিপর্যয়ে পড়েছে।
‘এই সুস্থ সবল তরুণের দিকে তাকিয়ে আমি দেখছিলাম। এই সম্পূর্ণ অদ্ভুত ব্যাপারটা তার কাছে সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে, তার মাও তার এই বিশ্বাসকেই সহযোগিতা করে যাচ্ছে।
মাদাম ফ্রাঞ্চিই নীরবতা ভেঙে হালকা হেসে বললেন। সে আমাদের সামনে নাই, সেও সৃষ্টিকর্তার সামনে রয়েছে, এটাই সান্ত্বনা। তোমার কোনো সন্দেহ নেই তো, সে বেঁচে আছে।
লুসিয়েন শান্তভাবে জানাল–‘তার মৃত্যু হলে তাকে আমি দেখতে পেতাম।
‘তাহলে তুমি নিশ্চয়ই আমাকে জানাতে।’
‘নিশ্চয়ই, সাথে সাথে, আমি শপথ করে বলছি মা।
তারপর তার মনে হয় খেয়াল হলো, আমার পক্ষে এই আলাপে অবাক হওয়ার কথা। তাই আমার দিকে ফিরে তিনি বললেন–‘মঁসিয়ে, ক্ষমা করবেন। বোঝেনই তো মায়ের মন। দুশ্চিন্তা চেপে রাখতে পারছি না। লুই আর লুসিয়েন আমার দুই সন্তান। এ বংশের শেষ বংশধর। আপনি আমার ডান দিকে বসুন। বাদিকে লুসিয়েনকে বসালেন।
বেশ বড় লম্বা একটা টেবিলের এক পাশে আমরা তিনজন বসেছি। অন্য পাশে ছয়টা প্লেট সাজানো আছে তাদের জন্য–কর্সিকান ভাষায় যাদের সব মিলিয়ে নাম হলো–সংসার। বড় বাড়িতে মালিক এবং চাকরের মাঝামাঝি যে লোক থাকে, সংসার বলতেই তাদের বোঝায়।
টেবিলে প্রচুর আয়োজন–কিন্তু খাবারের দিকে আমার মন নেই। অনেকগুলো অবাস্তব চিন্তা আমার মনে আসা যাওয়া করছে, যার ফলে খাওয়ার দিকে মন দিতে পারছি না। জোরালো ক্ষিদে পেয়েছে, তাই কিছু খেতে হলো ঠিকই, তাতে খাবারের আনন্দ পেলাম না।
আমি এ বাড়িতে আতিথ্য নিয়ে মনে হচ্ছে একটা অন্য পৃথিবীতে ঢুকে পড়েছি। অন্য জগতে আছি। এ মহিলা–সৈন্যদের মতো বন্দুক ব্যবহার করে। এ ভাই (এক লীগ তিন মাইল) তিনশো লীগ দূরের ভাই ব্যথা-বেদনা টের পায় এখানে বসে। মা শপথ করিয়ে নেয়, মৃত ভাইকে দেখতে পেলে সাথে সাথে তাকে জানাবে।
এই সব মনে করেই অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর মনে হলো, এভাবে মাথা নিচু থাকা অসৌজন্যর পরিচয়। শেষ পর্যন্ত মনকে ফিরিয়ে, মাথা তুলে ওঁদের দিকে তাকালাম।
তাকাতেই লুসিয়েন কথা শুরু করল–ঠিক যেন পুরানো কথার রেশ ধরে শুরু করল। তাহলে এ ব্যাপারে কর্সিকায় এলেন।
‘দেখতেই পাচ্ছেন, ভাবনাটা বেশ কিছুদিন থেকেই মাথায় ছিল, তাই বেরিয়ে পড়লাম।
‘আর দেরি না করে ভালোই করেছেন। যেভাবে ফরাসি রুচি ও আচার আচরণ এদেশে এসে পড়েছে তাতে যারা আর কিছুদিন পড়ে এখানে আসবেন। তাঁরা কর্সিকান দেখতে পাবেন না।
‘যদি কোনোদিন সে সময় আসে, ফরাসি সভ্যতার তাড়া খেয়ে প্রাচীন কর্সিকা আসা বৈশিষ্ট্য যদি দেশের দূরে কোথাও আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় তবে যে কোনো কোথায় হবে, তা আমি ভাবিনি। সে হবে ট্যাভরো উপত্যকার সার্টেন প্রদেশে। আমি উত্তর দিলাম।
লুসিয়েন হেসে ফেলল–‘আপনার তাই ধারণা?
‘কেন হবে না সেই ধারণা? আমার সামনেই যে বসে আছে তার উজ্জল নমুনা।
তা, ঠিক, কিন্তু দেখুন, আমার মা আছেন, আমি আছি, চারশো বছরের পুরনো ঐতিহ্য আছে, তবে তার ফাঁক দিয়ে ফরাসি সভ্যতা ঢুকে পড়েছে, কেড়ে নিয়েছে আমার ভাইকে দূর প্যারিসে, যেখান থেকে সে উকিল হয়ে ফিরে আসবে, দেশে ফিরে এসে থাকবে আজাইচোতে, নিজের পিতার বাড়িতে না। সে ওকালতি করবে, হয়তো সরকারি উকিল হবে, মামলা চালাবে সেসব লোকের বিরুদ্ধে যারা বংশানুক্রমিক প্রতিহিংসার পালা উদ্ধার করতে গিয়ে শত্রুকে নিজ হাতে হত্যা করেছে। অর্থাৎ প্রতিজ্ঞাপালনকারীকে সে সাধারণ খুনির পর্যায়ে নামিয়ে আনবে। আমাদের পূর্বপুরুষরা যে কাজকে অবশ্য করণীয় বলে প্রচার করে গিয়েছেন, সেই কাজকে সে মহাপার বলে ঘোষণা করবে। শাস্তি দেবার ব্যবস্থা করবে তার আদেশ পালনকারীকে। সৃষ্টিকর্তার বিচার বাদ দিয়ে চালিয়ে দেবে মানুষের বিচার এবং প্রতিজ্ঞাপালনকারী একজনকে যদি সে ফাঁসি দিতে পারে। এই বলে সেদিন তার আত্ম প্রসাদ হবে যে সভ্যতার দেয়ালে একটা ইট সে গেঁথে দিয়েছে। হা ঈশ্বর, হা ঈশ্বর। ভাবাবেগের জন্য লুসিয়েনের কথা বন্ধ হয়ে গেল। সৃষ্টিকর্তা ডাকতে ডাকতে উপর দিকে এমনভাবে চোখ তুলে চাইল মনে হলো এ ঠিক এভাবে পরাজিত অনিবার্য (কার্থেজীয় বীর, রোমের পরম শত্রু) চেয়েছিল জামা যুদ্ধের পর।
আমি তার ব্যথায় সান্ত্বনা দিলাম, ‘সৃষ্টিকর্তা কিন্তু সুন্দর ভাগ করেছেন। আপনার ভাই যেমন নতুনের পক্ষে-তেমনি আপনি হয়েছেন প্রাচীন যুগের ভক্ত।
‘প্রাচীন যুগের অনুসারী? সেটা কোথায়? আমি তো এমন সব কাজ করি যা ফ্রাঞ্চি বংশধরের উপযুক্ত কাজ না।
সবিস্ময়ে বললাম, আপনি বলেন কী?