‘ঠিক, পাওলির পাশে একটা তরোয়াল।’
‘হ্যাঁ।’
‘তারই তরোয়াল।
‘বলেন কি তারই তরোয়াল? এটাও নিশ্চয়ই স্যামপিত্রোর ভোজালির মতো মূল্যবান।
‘হ্যাঁ, এটাও মালিক নিজে থেকে দিয়েছেন। তবে ওটা দিয়েছেন কোনো বুড়ো পিতামহ কে না, দিয়েছেন বুড়ো মাতামহীকে।
‘এক মহিলাকে তরোয়াল উপহার?
‘তাঁর কথা আপনি শুনতে পারেন। সুল্লাকারোর দুর্গে এক মহিলার আবির্ভাব হয়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। তার সঙ্গী ছিল এক যুবক।
‘না। যদি আপনি ঘটনাটা বলেন।
‘সুল্লাকারোতে এসে মহিলা আর এই যুবক পাওলির সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন, পাওলি তখন লেখার কাজে ব্যস্ত ছিল, বলে দিলেন দেখা হবে না। মহিলাটি চাপাচাপি করতে লাগল, প্রহরীরা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। পাওলির কানে এই গোলমালের গেলে, তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
মহিলা জানালেন, ‘আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই।
পাওলি জানতে চাইলেন, কী বলতে চান?
‘আমার দুটি ছেলে, কাল খবর পেলাম যে বড় ছেলে স্বাধীনতার যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে, শুনে আমি ষাট মাইল হেঁটে আপনার কাছে এসেছি, ছোট ছেলেটিকে আপনার সৈন্য দলে দেবার জন্য। সে আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
‘এক কালে স্পার্টার মহিলাদের সম্পর্কেই এ ধরনের কথা শোনা যেত। এ মহিলাটি কে?
‘আমার পিতামহ, নিজের কোমর থেকে খুলে পাওলি তরোয়াল তুলে দিয়েছেন আমার দাদীর হাতে। বলুন সে এই তরোয়াল পাওয়ার যোগ্য কি না?
‘নিঃসন্দেহে যোগ্য। কিন্তু ওপাশের তরোয়ালটি–
‘এটা তো নেপোলিয়নের তরোয়াল। পিরামিডের যুদ্ধে এটাই তিনি ব্যবহার করেছিলেন।’
‘এটাও নিশ্চয়ই আপনার পরিবারে ওইভাবে এসেছিল।’
‘তখন পিরামিডের যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ শেষ হয়েছে, তখনও এক দল মামলুক সৈন্যরা তাদের আহত সর্দারকে নিয়ে যুদ্ধ করবার জন্য তৈরি। আমার পিতামহ ছিলেন গাইড সৈন্য দলের এক সেনাপতি। নেপোলিয়ন তাকে ওই দলটাকে আক্রমণ করতে আদেশ দিলেন। যুদ্ধে পরাজিত করে, আহত সর্দারকে বন্দি করে নিয়ে এলেন নেপোলিয়নের সামনে। তারপর তরোয়াল যখন খাপে ভরতে যাবেন, দেখলেন, মামলুকদের কারণে তরবারির আঘাতে আঘাতে তার তরোয়াল এমনভাবে বাঁকা হয়েছে যে, তা আর খাপে ঢোকানো যাচ্ছে না। পিতামহ তখন খাপ আর তরোয়াল দুটোই ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। বোনাপার্টি তখন নিজের তরোয়ালটিই তাকে দিয়ে দিলেন।
একটু সময় আমি চুপ থেকে বললাম–নেপোলিয়নের তরবারিটা আপনারা যত্ন করে টানিয়ে রেখেছেন, কিন্তু আমি হলে এ দেয়ালে আমার পিতামহের বাঁকা তরোয়ালটাই শোভা পেত।’
‘ওই উল্টো দিকে তাকিয়ে দেখুন। নেপোলিয়নের ঠাকুরদার ভাঙা তরোয়ালটা যত্ন করে কুড়িয়ে নিয়েছিলেন। তারপর তার হাতলে একটা হীরা বসিয়ে আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ওতে একটা লাইন লিখে দিয়েছিলেন, পড়ে দেখুন।
সামনে গেলাম, দুই জানালার মাঝখানে ভাঙা তরোয়ালটা রয়েছে। যতটা খাপের মধ্যে ঢোকে ততটা ঢোকানো বাকিটা বাইরে।
সামনে গিয়ে পড়ে দেখলাম–সেই বাকানো পাত্রের উপরে সোজা একটা লাইন খোদাই করা।
‘২১ জুলাই, ১৭৭৮ পিরামিডের যুদ্ধ।
সেই চাকরটি এবার এসে দেখা দিল, যে এর আগে আমাকে দরজা খুলে দিয়েছিল এবং লুসিয়েনের ফেরত আসার খবরও জানিয়েছিল।
সে লুসিয়েনকে জানাল–মঁসিয়ে, মাদাম ফ্রাঞ্চি আপনাকে জানাতে বলল, যে খাবার তৈরি।
লুসিয়েন বলল–‘গ্রিফো–তুমি মাকে গিয়ে জানাও আমরা এক্ষুণি যাচ্ছি ।’
পাহাড়ে চড়ার পোশাক পড়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে এল, ভেলভেটের ছোট জামা, পাজামা আর পট্টি। কোমরে তার আগের দেখা কার্তুজ ভরা বেল্ট। এদিকে আমি তখন দুটি বন্দুক দেখছি। সামনের দেয়ালে ও দুটো ঝোলানো আছে। দুটোরই বাঁটের উপরে একই তারিখ খোদাই করা। ২১ সেপ্টেম্বর ১৮১৯ সকাল ১১টা।’
‘এ দুটোরও কোনো ঐতিহাসিক মূল্য আছে নাকি?’ বন্দুক দুটো দেখিয়ে প্রশ্ন করলাম।
‘আছে, অন্তত আমাদের কাছে। একটি ছিল বাবার। সে থামল।’
‘দ্বিতীয়টি।
সে হেসে বলল। অন্যটি মায়ের। কিন্তু খাবার দিয়েছে। চলুন নিচে যাই।’
.
৩.
‘মায়ের বন্দুক।’
নিচে নামার সময় ওই কথাটাই আমার কানে বাজতে লাগল বারবার, মায়ের বন্দুক। খাওয়ার ঘরে ঢুকে, মাদাম ফ্রাঞ্চিকে ভালো ভাবে দেখলাম। প্রথম দেখায় এভাবে খুঁটিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করেনি। তার ছেলে ঘরে ঢুকেই মায়ের হাতে চুমু খেল। মাও সে শ্রদ্ধা নিবেদনকে সম্রাজ্ঞীর মর্যাদা দিয়েই গ্রহণ করলেন।
‘বড় দেরি হয়েছে, মা মাফ কর।
আমি সালাম দিয়ে বিনিতভাবে বললাম, ‘দোষটা আমারই। সিয়ে লুসিয়েন এত মূল্যবান ঐতিহাসিক জিনিস আমাকে দেখাচ্ছিলেন–তার ফলে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই ওর এত দেরি হয়েছে।’
মা হাসিমুখে বললেন–‘ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? আমিও তো এই মাত্র নিচে নেমেছি। তারপর লুসিয়েনের কাছে জানতে চাইলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম তোমার কাছে লুইর খবর পাব।
আমি মাদাম ফ্রাঞ্চি না বলে পারলাম না। আপনার ছেলে কি অসুস্থ?’
‘লুসিয়েনের ধারণা তো তাই।’
‘চিঠি এসেছে নাকি?’
‘না, চিঠি পাইনি বলেই তো ভাবছিউত্তর দিল লুসিয়েন।’
‘কিন্তু অসুস্থ হয়েছেন। এমনটা ভাবছেন কেন?’
‘ভাবনা এ কারণে যে, কয়েকদিন ধরে নিজেই ভালো নেই।’
মাফ করবেন, বার বার প্রশ্ন করে বিরক্ত করছি। কিন্তু আপনি ভালো নেই বলে কীভাবে বোঝা গেল আপনার ভাইও অসুস্থ।