এখানে কথা থামিয়ে একটু হেসে ফেলল। তারপর আবার বলতে শুরু করল, ‘আমি রীতিমতো বর্বর একজন মানুষ। পৃথিবীতে আসতে আমার ১০০ বছর দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু এভাবে যদি কথা বলতে থাকি, তাহলে খাওয়ার আগে পোশাক বদলানো হবে না আমার।’
‘কিন্তু পোশাক বদলাতে বদলাতেও তো কথা বলা যায়–এক মিনিটের জন্যও ওকে আমার ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না। ঐ সামনের ঘরটা তো আপনার। দরজাটা খুলে রেখে আপনার ঘর থেকে কথা বলুন, আমার ঘর থেকে আমি বলি।
‘তার চেয়েও ভালো হয়, আপনি যদি আমার ঘরে আসেন। ঘরের সাথেই আমার পোশাকের ঘর। আপনি অস্ত্রশস্ত্র ভালোবাসেন তো? আমার অস্ত্রশস্ত্র দেখুন। এর ভেতর কিছু ঐতিহাসিক মূল্যও আছে।’
এটাই চাইছিলাম আমি। দুই ভায়ের দুইটা ঘর দেখাতেই ওদের রুচি পার্থক্য সহজেই আমার চোখে পড়বে। এ সুযোগ ছাড়া যায় না। কাজেই লুসিয়েনের মুখ দিয়ে কথা বেরুবার সাথেই আমি তার পেছনে চললাম।
নিজের ঘরের দরজা খুলে লুসিয়েন আমাকে তার ঘরে ঢুকার জন্য ইশারা করল। এক পা ভেতরে ঢুকে আমার মনে হলো–ঢুকে পড়েছি একটা অস্ত্রাগারে।
এখানের সব ফার্নিচার পনেরো/ষোলো শতাব্দীর। পালঙ্কের চারদিকে চারটি মোটা কাজ করা দামি কাঠের খুটি, তাদের মাথার উপরে সবুজ ভেলভেটের চাদোয়া, চাদোয়ার গায়ে সোনালি ফুলের বুটি। জানালাতেও ওই একই কাপড়ের পর্দা।
দেয়ালে স্পেনের চামড়ার আবরণ। যেখানে একটু ফাঁক রয়েছে, উঁচু টেবিলে বা ব্রাকেটের উপর আধুনিক বা মধ্য যুগীয় কোনো বিশেষ অস্ত্র রেখে দেয়া হয়েছে। যে লোক এ ঘরে থাকে তার রুচির ব্যানারে বুঝতে আর বাকি থাকে না। এর ভাই যেমন শান্তি প্রিয়, এ তেমনি যুদ্ধবাজ।
পোশাকের ঘরে ঢোকার সময় লুসিয়েন বলল, ‘ভালো করে এসব দেখুন। তিন শতাব্দীর অস্ত্রের নমুনা এখানে পাবেন। আমি ততক্ষণে পাহাড়ে চড়ার পোশাকটা পরেনি খাওয়ার পরেই বের হতে হবে।
আপনি বলেছিলেন কোনো কোনো অস্ত্রের ঐতিহাসিক মূল্য আছে, সে কোনগুলো? তরোয়াল, না বন্দুক, না ভোজালি?
সে ধরনের তিনটি আছে। এক নম্বর ওই ভোং টা যেটা আমার বিছানার মাথার কাছে রয়েছে, লম্বা হাতল বাটের উপর সীল মোহর আঁকা।
‘হ্যাঁ দেখেছি। বলুন এবার।’
‘ওটা হলো স্যামপিত্রোর ভোজালি।’
‘বলেন কি? সেই কুখ্যাত স্যামপিত্রো? ভ্যানিলাকে যে হত্যা করেছিল?
‘হত্যা করেছিল বলবেন না, বলুন ভ্যানিলার উপর প্রতিহিংসা নিয়েছিল।’
‘আমার কাছে তো দুটোই এক রকম লাগে।’
‘যারা কর্সিকার বাইরের লোক, তারা ওই রকমই ভাবে। স্যাসলিত্রো কর্সিকাবাসীদের চোখে অন্যরকম।
‘সে কথা থাক–ভোজালিটা সত্যি তার তো?’
‘লক্ষ্য করুন, স্যাসলিব্রোর বংশ পরিচায়ক অস্ত্র চিহ্ন খোদাই করা আছে। শুধু বাদ পড়েছে ফ্রান্সের রাজকীয় লিলি ফুল। পার্পিসার অবরোধের পরে স্যাসলিত্রোকে লিলি ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়।
‘আমি কিন্তু এটা জানতাম না। কিন্তু আপনার হাতে এল কি করে এ ভোজালি?
‘আজ তিনশো বছর আমাদের বংশে রয়েছে এই ভোজালি। স্যাসপিত্রো নিজেই ওটা দিয়েছিলেন আমার পূর্ব পুরুষ লেলোলি’র দ্য ফ্রাঞ্চিকে।
‘উপলক্ষ্য?
‘উপলক্ষ্য হলো এই। স্যাসপিত্রো আর আমার ওই বুড়ো পূর্ব পুরুষ এক সময়ে একসঙ্গে জেনোয়াবাসীদের পাল্লায় পড়েন। জেনোয়ার সৈন্যরা ওত পেতে ছিল, হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে ওদের ওপর। অসাধারণ বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন দুজনে, স্যাসপিত্রোর শিরস্ত্রাণ খুলে পড়ে যায় এক ঘোড়সওয়ার শক্ত লোহার মুগুর তোলে তার মাথার উপরে। ঠিক সেই সময়ে বুড়ো পিতামহ তার ভোজালি ঢুকিয়ে দেয় শত্রুর লৌহবর্মের জোড়ের মুখ দিয়ে। আহত হয়ে লোকটা তো ঘোড়া ছুটিয়ে দে দৌড়। কিন্তু বুড়ো পিতামহ আর তার ভোজালি খুলে নিতে পারলেন না তার দেহ থেকে। এত গভীরভাবে অস্ত্রটা ঢুকে গিয়েছিল, অত তাড়াতাড়ি তা বের করে আনা গেল না। তখন তাঁর আপসোস দেখে কে! তার বড় শখের হাতিয়ার ছিল ওটা, ভদ্রলোকের ক্ষতিটা অপূরণীয় মনে হতে লাগল। তার দুঃখ দেখে স্যামপিত্রো তাঁকে নিজের ভোজালি উপহার দিলেন, খাস স্পেনের তৈরি। দুটো পাঁচ ফ্রাঙ্ক মুদ্রা রেখে এই ভোজালি দিয়ে কোপ দিলে দুটোই কেটে যাবে।
‘বলেন কি?’
‘পরীক্ষা করেই দেখুন না।
আমি মেঝেতে দুইটা মুদ্রা একটার উপর আর একটা রেখে ভোজালি দিয়ে জোরে কোপ দিলাম। দেয়ার পর দেখা গেল, লুসিয়েনের কথাই ঠিক। দুটো মুদ্রা কেটে দুই ভাগ হয়ে গিয়েছে।
হেসে বললাম, ‘সন্দেহ নাই, এটা স্যামপিত্রোর ভোজালি, কিন্তু ভাবতে অবাক লাগছে, এরকম ধারালো অস্ত্র থাকতেও তিনি স্ত্রীকে মারার জন্য দড়ির ফাঁস ব্যবহার করলেন।
‘বাঃ এ অস্ত্র তখন কোথায়? অনেক আগেই এটা আমার বুড়ো পিতামহকে দিয়ে দিয়েছেন।
‘হ্যাঁ, কথাটা ঠিক।
‘তার বয়স তখন ষাট। পৃথিবীকে একটা মূল্যবান শিক্ষা দেয়ার জন্য স্যামপিত্রোকে কনস্ট্যাল্টিলোপন থেকে আই-তে ছুটে আসতে হলো। শিক্ষাটা এই, রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে কোনো মহিলাকে নাক গলাতে দেয়া উচিত না।
এর উত্তর আমার কাছে ছিল না। নীরবে আগের জায়গায় ভোজালি রেখে দিলাম। লুসিয়েনের তখন পোশাক পরা হয়নি। আমি অন্য দুইটি ঐতিহাসিক জিনিস জানতে চাইলাম।
‘পাশাপাশি ওই দুটি ছবি দেখেছেন?’
‘হ্যাঁ, পাওনি আর নেপোলিয়ন।’