অতিথিকে শুভেচ্ছা জানাতে সরাসরি বাইরের পোশাকেই চলে এসেছেন আমার কাছে। তার পরনে সবুজ সুতি ছোট জামা, ছাই রং সুতি পাজামা, পায়ে কাঁটাওলা বুট, কোমরে বুলেট বেল্ট থাকায় চেহারাতে মিলিটারি ভাব এসেছে, মাথায় টুপি-অনেকটা ফরাসি বাহিনীর আফ্রিকার সেনাদের মতো।
বুলেট বেল্টের ভেতরে বুলেট। বাইরের একপাশে পানির বোতল, অন্য পাশে পিস্তল। কাঁধে ঝুলানো একটা বন্দুকও রয়েছে।
একটু দৃঢ় ভাব তার চলাফেরায়, চোখের দৃষ্টি তার স্থির। কাজের লোক তাতে সন্দেহ নেই।
আমার পোশাক, বাক্স-সবই। সেও একপলকে সবকিছুই দেখে নিয়েছে।
‘নিশ্চয় বিরক্ত করিনি মঁসিয়েকে? এ দিয়েই শুরু করল সে–মাফ করবেন। আপনার কোনো কিছুর দরকার আছে কি না, জানার জন্য তাড়াতাড়ি চলে এলাম। এবার একটু হেসে বলল, ‘আসলে বাইরে থেকে কেউ আমাদের গরিবের ঘরে এলে, আমি ভয়ানক ঘাবড়ে যাই। সত্য কথা, আমরা কর্সিকার লোকেরা এখনও অসভ্য। তাই সুসভ্য ফরাসিদের কথা ছেড়েই দিলাম, যে কোনো লোককে আমাদের পুরানো ধরনের আতিথ্যের জন্য ভয় করে। অবশ্য আমরা প্রাচীন এই মত পাল্টাতে রাজি না, কারণ আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য সবই তো চলে গেছে। শুধু এটাই আছে।
আমি জবাব দিলাম, আপনি অকারণে ভয় পাচ্ছেন। মাদাম ফ্রাঞ্চি যেভাবে সব ব্যাপারে দেখাশুনা করেছেন এবং এই ঘরে বসে বাইরে না চাইলে মনে হয় না যে আমি বিদেশে আছি। ফ্রান্সের রাজধানীতে নেই। কাজেই নিজেকে অসভ্য বলে যা বলতে চেয়েছেন সেটা শুধু রহস্য ছাড়া আর কিছুই না।’
লুসিয়েন হেসে বলল, এই ঘরটা ফ্রান্সের ঘরগুলোর মতো করেই সাজানো। এটা ভাই লুইয়ের জন্য। সে ফরাসি ফ্যাশনে বাস করতে ভালোবাসে। তবুও আমার মনে হয় এই ঘর তাকে এবার ফ্রান্স থেকে ফিরে এলে আর তৃপ্তি দিতে পারবে না।
আমি জানতে চাইলাম–‘অনেক দিন থেকেই কি আপনার ভাই প্যারিসে আছেন?’
‘না। মাত্র দশ মাস।’
‘তাড়াতাড়ি কি ফেরার কথা আছে?’
‘তিন-চার বছরের ভেতর না।’
‘আপনাদের দুই ভাইয়ের মনে হয় আগে কখনও ছাড়াছাড়ি হয়নি। এখন এই দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে কষ্ট হবে না?
‘অবশ্যই হবে। আমরা যে এক সাথে ছিলাম তাই না, একে অন্যের জন্য টানও বেশি।
‘তাহলে–সে অবশ্য পড়াশোনা শেষ হবার আগে আপনার সাথে দেখা করে যাবেন।
‘যেতে পারে। আমাকেও সে কথাই বলে গিয়েছে।
‘কিন্তু সে এলো না। আপনিও তো তার সাথে গিয়ে দেখা করতে পারেন।
‘আমি? আমি কখনও কর্সিকার বাইরে যাই না।’
দেশপ্রেমিক অনেক আছে। লুসিয়েনের বলার ভাব থেকে এটাই মনে হলো, তাদের জন্মভূমিই সবার চেয়ে সেরা অন্য সব দেশ তুচ্ছ। তার দেশ প্রেম একটু উগ্রই মনে হলো।
আমি হেসে ফেললাম।
লুসিয়েনও হেসে ফেলল তা দেখে, ‘আপনি, এমন অদ্ভুত লোক দেখেননি, যে কর্সিকার মতো হতভাগা দেশ ছেড়ে বেড়াতে যায় না, তাই হাসছেন। কিন্তু কি আশা করেন আপনি? আমার জন্ম এই মাটিতেই। এই সমুদ্রের বাতাসেই আমি বাঁচি। এখানের পাহাড়ের কুয়াশায় আমার চোখ যেমন পরিষ্কার হয়। সেটা আর কোথায়ও হয় না। ঝরনা-পাহাড় ঘুরে বেড়িয়ে জঙ্গলের রহস্য আবিষ্কার করে আমি যে আনন্দ পাই–সেটা অন্য কোথায়ও নেই। আমরা চাই অবাধ স্বাধীনতা। আমাকে যদি শহরে যেতে হয়, তাহলে বোধহয় মারাই যাব।’
আমি তাকে তাদের দু’ভাইয়ের এই পার্থক্যের কারণ জানতে চাইলাম।
‘তাকে সামনে দেখলে, অন্য কিছু বলতেন আপনি। চেহারায় এমন হুবহু মিল থাকার পরেও, প্রকৃতি কেমন করে এত আলাদা হলো।
‘দুজন বুঝি একই রকম দেখতে?
‘একদম। ছোটকালে মা আমাদের জামায় আলাদা চিহ্ন দিয়ে রাখতেন। যাতে সহজে চেনা যায়।
‘বড় হবার পর?
বড় হওয়ার পর গায়ের রং একটু সামান্য তফাৎ হলো। আর কিছু নয়। সব সময় ঘরে বসে বই পড়া আর ছবি আঁকার জন্য ভাইয়ের রঙ একটু ফ্যাকাসে হয়ে গেল, ওদিকে আমি পাহাড়, জঙ্গলে ঘুরে বেড়াবার ফলে গায়ের রং হলো তামাটে।
‘নিজের চোখে দুজনকেই পরীক্ষা করতে ইচ্ছে হচ্ছে আমার। যাওয়ার সময় মঁসিয়ে লুই দ্য ফ্রাঞ্চির কাছে কোনো চিঠি দেন, তাহলে সেটা দেয়ার সুযোগে তাকে দেখতে পাব বলে আশা করি।
‘আপনি যদি অনুগ্রহ করে সে কষ্ট স্বীকার করেন। অবশ্যই দেব। আনন্দের সঙ্গে দেব। কিন্তু আপনার পোশাক পরা প্রায় শেষ। আর আমি শুরু করিনি। কিন্তু আর পনেরো মিনিটের মধ্যে আমরা খেতে বসব।’
আমি জানতে চাইলাম, পোশাক বদল কি আমার খাতিরে?
উত্তর দিল, সে যদি হয়, দোষ আপনার। নিজে পোশাক পাল্টিয়ে আমাকে পথ দেখিয়েছেন। আমার পরা আছে ঘোড়ার চড়ার পোশাক। এগুলো বদলে পাহাড়ে চড়ার পোশাক আমাকে পড়তে হবে। রাতের খাবারের পর আমাকে এক জায়গায় যেতে হবে। এই কাটাওলা বুট তাই পাল্টাতে হবে।
‘খাবার খেয়েই বের হবেন?’
‘একজনের সঙ্গে দেখা করতে হবে।’
আমি হাসলাম।’
‘না, না, আপনি যা ভাবছেন তা নয়। এটা অন্য কাজ।’
‘আমাকে সবকিছু খুলে বলবেন–এটা অবশ্যই আশা করি না।’
‘কেন করবেন না? আমার লুকোবার কিছু নাই। এমন ভাবি আমি চান না যাতে কোনো কিছু আমার লুকোবার প্রয়োজন হয়। আমার কোনো প্রেমিকা ছিল না। হবেও না কোনোদিন। তাই যদি বিয়ে করে, তার বাচ্চা হয়। তাহলে সম্ভবত আমি বিয়েও করব না। তবে সে যদি বিয়ে না করে। তখন বংশ রক্ষা করতে আমাকে বিয়ে করতেই হবে।’